বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর অধিকার বঞ্চনা

নারীর সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ আজ বাধাগ্রস্ত ও অরক্ষিত। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ নারীর অশ্রম্নপাত আমরা কয়জন পুরুষ শুনতে পাই?
সাইফুজ্জামান
  ০৮ মার্চ ২০২১, ০০:০০

আন্তর্জাতিক নারী দিবস শুধুমাত্র একটি দিন নয়। আত্মসচেতনতা, অধিকার অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নারীর অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে তা নিয়ে ভাবনার একটি নতুন দিন। নারী একদিকে যোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, কর্মী, আত্মত্যাগী ও মোনালিসার অব্যাখ্যাত কোমল সৌন্দর্য ও বিহ্বলতার ধার। নারী তার শারীরিক সীমাবদ্ধতা ঝেড়ে ফেলে মেধা ও যোগ্যতায় অনেক ঊর্ধ্বে আরোহণ করেছে। একুশ শতকের এই উত্থানের নারী গতানুগতিক ধারায় বন্দি নয়। নারী তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে এক আলোকিত ভুবন তৈরি করেছে। নারী দিবস সামনে কিছু বিষয় অবতারণা করছি। কন্যা, জায়া, জননী নারী তার পরিচয় ব্যপ্ত করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সে যেমন কুশলতার পরিচয় দিয়েছে, বিজ্ঞান গবেষণায় ছুঁয়েছে সাফল্যের সোপান। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার তাকে বারবার বঞ্চিত করেছে। নারীকে আমরা শুধু নারী হিসেবে দেখব, নাকি মানুষ হিসেবে, সেবক হিসেবে ও সমাজ রূপান্তরের কারিগর হিসেবে দেখব, এ ভাবার যথাযথ সময় এসেছে। পেছনে ফিরে গেলে আমরা দেখতে পাই নারী দিবসের ভাবনা কোথা থেকে শুরু, প্রথমবার ২৮ ফেব্রম্নয়ারিতে রুটি ও শান্তির দাবিতে প্রথম রাশিয়ান নারীরা প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের প্রতিবাদে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি প্রথম নারী দিবস পালন করা হয়। ১৯০৮ সালে নারী বস্ত্র শ্রমিকরা তাদের পারিশ্রমিক, নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা আদায়ের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। ১৯১০ সালের কোপেনহেগেন প্রচেষ্টার ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড প্রথমবার নারী দিবস পালনের সূচনা করে। কাজের অধিকার, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও কাজের সমতার বিষয় অগ্রাধিকার পায়। ইউরোপের নারীরা অধিকার সচেতন হয়ে জোটবদ্ধ হয়। ১৯১৩ সালে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রক্রিয়া সফল পরিসমাপ্তির দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৮ মার্চকে নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশে নারীরা মেধা ও যোগ্যতায় অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও কিছু সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী এক ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়ে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ অবধি নারীর অবমাননা প্রকট হয়ে উঠেছে। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার চিত্র প্রায় একইরূপ। রেল, বাস, কর্মক্ষেত্রে নারী তার সম্ভ্রম হারাচ্ছে। নারী তার শিশু বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নানা নিগ্রহের শিকার। বিকৃত পুরুষ যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে শুরু করে অধিকার বঞ্চনায় শেষ করে। ডিভোর্সপরবর্তী পাওনা নারী কম পায়। বিবাহ নামক সম্মতিমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর নারী তার মর্যাদা, অধিকার, প্রাপ্য পায় কয়টি পরিবারে? পদে পদে চলে লাঞ্চনা। কৃষি হাতে প্রথম শুরু। শিশু প্রতিপালন, ঘরকন্যার কাজ করাসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। উৎপাদন, বিনিয়োগ ও মেধার ব্যবহার নারী প্রগতি ও অগ্রযাত্রার বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। গৃহে নারী যে শ্রম দেয় তার জন্য কোনো পারিশ্রমিক বরাদ্দ নেই। এমনকি নূ্যনতম সম্মান, সহমর্মিতা সে পায় না। প্রতিদিন সকালে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ছোটে শ্রমিক নারী। সামান্য খাবার হয় নুন ভাত কিংবা সামান্য ডাল ভাত তার সঙ্গী। রাতে ক্লান্ত হয়ে সে ঘরে ফেরে গার্মেন্টস কিংবা অন্য জায়গা থেকে। নিম্ন বিত্ত, মধ্যবিত্ত অনেক সংসারে শুধুমাত্র নারীর উপার্জিত অর্থে পুরুষ ব্যক্তি, সন্তানদের জীবন নির্বাহ হয়। নারী তার সুখের জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করে না।

এনজিও প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থার উদ্যোগে নারীকে স্বাবলম্বী করার কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। ঋণ প্রদান অনুদান ও বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। এ সাহায্য পর্যাপ্ত নয়। গোবাদিপশু, হাঁস-মুরগি প্রতিপালন, সেলাই মেশিন ক্রয়ের জন্য টাকা দেওয়া হয়। নানা শর্তযুক্ত থাকে। বোঝা থেকে মুক্ত হতে নারীকে জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কৃষি ব্যাংক অন্যান্য প্রতিষ্ঠান অল্প টাকায় হিসাব খোলা ও ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে, এগুলো পর্যাপ্ত নয়। ফাঁদের ভুবন ভরা এই জগৎ সংসারে নারী এক বৃত্তাবদ্ধ জীবনযাপন করছে। স্বামীর লাম্পট্য, অত্যাচার নারীকে আজও সহ্য করতে হয়। রক্তচক্ষু, সামাজিক ব্যবস্থা, বৈষম্যের বেড়াজালে আটক নারী কি দেবে এই সমাজকে?

নারীর সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ আজ বাধাগ্রস্ত ও অরক্ষিত। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ নারীর অশ্রম্নপাত আমরা কয়জন পুরুষ শুনতে পাই?

নারী মমতাময়ী মা, স্ত্রী, প্রেমিকা ও সমাজ উন্নয়নের শক্তিশালী স্তম্ভ, তাকে দিতে হবে নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও অধিকার সুযোগ। তা হলে অন্ধকার আরো ঘনীভূত হবে।

\হসাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে