শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালের সড়ক দুর্ঘটনা শঙ্কা নয় চাই সচেতনতা

নতুনধারা
  ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:০০

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। করোনার ভয়াল থাবার শিকার বিশ্বের প্রায় ২১০টি দেশ। আর করোনার প্রভাব পড়েছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ সব কিছুর উপর। তবে আশার কথা, করোনার প্রভাব কমতে শুরু করেছে টিকাও আবিষ্কার হয়েছে। ফলে করোনার বিদায় ঘণ্টা বাজবে প্রত্যাশা সবার। এই বার্তাটি শঙ্কা দূর করলেও শঙ্কা তৈরি করছে সড়কের দুর্ঘটনা। ২৬ ফেব্রম্নয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। আর একই দিনে করোনাভাইরাসে মৃতু্য হয়েছে ১১ জনের। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সিলেট, বগুড়া, বরিশাল, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, ঝিনাইদহ ও শেরপুরে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালে মোট ৪০৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৯৬৯ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন। জাতীয় প্রেসক্লাবে সড়ক দুর্ঘটনার এ পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। এসময় জানানো হয়, ২০২০ সালে রেলপথের দুর্ঘটনায় ১২৯ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হন আর নৌপথের দুর্ঘটনায় ২১২ জন নিহত ও ১০০ জন আহত বা নিখোঁজ হন। নিসচার প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে বেশি ৪৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হন। আর এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে কম যথাক্রমে ১৩২ ও ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশে লকডাউন থাকায় দুর্ঘটনা কম হয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন লিখিত বক্তব্যে জানান- ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এলাকায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) এলাকায় কম দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি দাবি করেন, এসব এলাকায় চালকরা তুলনামূলক কম গতিতে নিয়ন্ত্রণে রেখে যানবাহন চালানোর কারণে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোট পাঁচ হাজার ২২৭ জন। যা ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সংখ্যার তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত হওয়ার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৩৯ জন। ফলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার সংখ্যা ৭৮৮ জন বেশি। আর ২০১৯ সালে আগের বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি ১ হাজার ৫৯৯টি। শতাংশের হিসাবে যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনগুলো হলো- বাস ৯৯২টি, ট্রাক ১ হাজার ৩৩টি, মোটরসাইকেল ১ হাজার ৯৮টি, কাভার্ড ভ্যান ১৬০টি, মাইক্রোবাস ১৫৮টি, নসিমন ৮৩টি, কার ৭৯টি ও অন্যান্য (সিএনজি/ভ্যান/পিক-আপ) ২ হাজার ১৭৮ টি। এসব যানবাহনের মোট নিহত চালক হলো ১ হাজার ১৯০ জন। নিহতের মোট ২২ শতাংশ চালক। সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার জন পথচারী মারা গেছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৫০ দশমিক ০৪ শতাংশ। বিগত ২ বছরের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

উপরের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দিন দিন আরও অনিরাপদ হচ্ছে সড়ক পথ। এই বছর অর্থাৎ ২০২০ যেভাবে শুরু হয়েছিল তাতে হয়তো পরিসংখ্যানে ২০১৯-কে ছাড়িয়ে দীর্ঘ পথ নিত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী দীর্ঘদিন যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সংখ্যাটা কম। মানুষের কর্মব্যস্ততা বাড়ছে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে সেখানে সড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি সত্যিই একটি জাতীয় সমস্যা বলে আমার মনে হয়। সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণই রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যান বেড়ে যাওয়া, ব্যস্ত সড়কে স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত যান চলাচল, চালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো ও প্রতিযোগিতা, ত্রম্নটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইন প্রয়োগের অভাব, লাইসেন্স না থাকা চালক নিয়োগ এবং অদক্ষ চালক বা কন্ডাক্টরদের কাছে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি ভাড়া দেওয়া। এ ছাড়া ট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বোঝাই ও চালকদের ওভারটেকিং, বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানো, পথচারী ও ছোট গাড়ির চালক বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, দূরপালস্নার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের বেহাল দশা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

আমরা যদি দুর্ঘটনার মূল হোতা খুঁজতে যাই তাহলে সহজ উত্তর চালক। কারণ চালকের দ্বারাই দুর্ঘটনাগুলো সংগঠিত হয়। কিন্তু যদি এর ভেতরের খবর জানতে চাই তাহলে কিন্তু সমীকরণটা পরিবর্তন হতে দেখা যায়। কীভাবে ভাবুন! চালককে চাকরি দেয় মালিক। চালক বেকার থেকে মুক্তি পেতে, তার সংসার চালানোর তাগিদে কম জেনেই হোক আর টাকা দিয়েই হোক চাকরি নেয়। তারপর চলে লাভের সমীকরণ। মালিকপক্ষ তার পকেট ভারী করতে চাপ প্রয়োগ করে চালককে। আর চালক তার চাকরি রাখতে ছুটে চলে চরম গতিতে। মালিক যদি চালকের সঠিক অভিজ্ঞতা বা সক্ষমতা যাচাই করে চালক নিয়োগ দেয়, অতিরিক্ত অর্থের জন্য চাপ না দেয় তাহলে মনে হয় সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব। দায় এড়াতে পারে না চালকও। কারণ চালক যদি সঠিকভাবে চালনা করা শেখে যানবাহন চালায় এবং মালিকের অতিরিক্ত অর্থের তাগিদের পেছনে না ছোটে তাহলে কিন্তু দুর্ঘটনার শিকার হতে আমরা অনেকেই মুক্তি পেতে পারি। চালকও কিন্তু আমাদের মতোই মানুষ। তাদেরও সংসার, মা-বাবা, সন্তান বা পরিবার-পরিজন রয়েছে। যদি চালকরা দক্ষতার সঙ্গে ঝুঁকিমুক্তভাবে যানবাহন চালায় তবে কিন্তু তাদের পরিবারও নিরাপদভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। ঢাকা শহরে যারা গাড়িতে উঠেছেন বা দেখেছেন তারা সবাই বুঝেছেন চালকদের দৌরাত্ম্য। কীভাবে তারা ওভারটেক করে? ভেতরে থাকলে মনে হয় গেম খেলছি। তাদের সেই প্রতিযোগিতা এখন রাজধানী শহরের বাইরেও শুরু হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাধারণ জনগণেরও কম দোষ নেই। অনেকেই না দেখে না বুঝেই সড়ক পার হওয়ার চেষ্টা করি। মানছি না ট্রাফিক আইন, অনুসরণ করছি না রাস্তা পারাপারের পূর্বশর্ত। আর রাজধানী শহরে সময় বাঁচাতে অনেকে ফুটওভার ব্রিজকে অপ্রয়োজনীয় মনে করি ফলে সময় বাঁচাতে গিয়ে জীবনকেই বিলিয়ে দিই। এই হলো সড়ক দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ তিন সারথী। মূল কথা হলো- মালিকদের আর্থিক লভ্যাংশ, চালকদের চাকরি রক্ষা ও বেপরোয়া চালনা এবং জনসাধারণের অসচেতনতার কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। এখানে প্রথমে মালিক, তারপর চালক ও সর্বশেষ জনসাধারণকে দোষ দেওয়া যায়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার পরোক্ষ কারণও রয়েছে অনেক। এইবার দেখি পরোক্ষ কারণ। চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিই সরকারের বাংলাদেশ সড়ক ট্রান্সপোর্ট অথরিটি। একটি চালক যদি সঠিকভাবে চালনা না শেখে তাহলে লাইসেন্স কীভাবে পায়? তাহলে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রয় করছে এটা ধরে নেবো কি?। ভাবছেন কি? যে সড়কের টাকায় তাদের বেতন সেই সড়ককে তারা অনিরাপদ করতে সার্টিফিকেট বিক্রি করে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছেন কি? সড়ক অনিরাপদ হওয়ার পেছনে যদি থাকে এমনই দীর্ঘ কারণ তবে কি সড়ক নিরাপদ হবে না? সড়ককে নিরাপদ করতে কেউ পারবে না? সরকার যদি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করে তাহলেই সম্ভব। প্রথমত বিআরটিএ-কে নজরদারিত্বে রাখতে হবে যেন কোনো অদক্ষ মানুষ লাইসেন্স না পায়। দ্বিতীয়ত, মালিকের চালক নিয়োগে ও যানবাহন সড়কে চলাচল করতে বিআরটিএর অনুমোদন বাধ্যতামূলক করতে হবে যেন লাইসেন্সের কার্যকারিতা ঠিক থাকে ও গাড়ির ফিটনেস ঠিক থাকে। তৃতীয়ত, সড়ক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে কোনো চালকের মধ্যে ওভারটেকিং প্রবণতা বা বেপরোয়া চালনা না থাকে। কোনো চালকের দোষে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করে রাখতে হবে। তাহলে সাসপেন্ডের ভয়ে চালক সতর্কভাবে গাড়ি চালাবে। সঙ্গে জনসাধারণকেও আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে শাস্তি বা দন্ড বিধান করতে হবে। তাহলে অসচেতনভাবে কেউ চলবে না বা আইনের প্রতি অনুগত থাকবে। দেশের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয়ই সরকারের একার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাই কমবে সড়কের দুর্ঘটনা। সবাই পাবো নিরাপদ জীবন। আসুন শঙ্কা না করে সচেতন হই। আমরা নিরাপদে পথ চলি, সড়কের গতিবিধি মেনে চলি। নিরাপদ জীবন গড়ি।

গোপাল অধিকারী

ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে