অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধী

আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ গ্রন্থে তিনি আরও বলেছেন- ‘১৯০৮ সালের পূবের্ পযর্ন্ত আমি চরখা কি তঁাত দেখিয়াছি বলিয়া আমার স্মরণ হয় না। তাহা হইলেও আমার ‘হিন্দ স্বরাজ’ বইতে ভারত বষের্ চরখার সাহায্যেই দারিদ্র্য দূর করা যায়, ইহা আমি বলিয়াছি। আমি ধরিয়া লইয়াছিলাম, যে পথে দেশের ক্ষুধা মিটিবে সেই পথেই স্বরাজ আসিবে।’ তিনি ওই পথেই সফল হলেন। ভারতবাসীকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিলেন।

প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

তারাপদ আচাযর্্য
যুগে যুগে কিছু মানুষ আসেন যাদের নেতৃত্ব দশর্ন পাল্টে দেয় দুনিয়াকে দেশকে দেশের মানুষকে। যার আলোয় আলোকিত হয় মানুষ ও দেশ। তেমনি একজন মানুষ মহাত্মা গান্ধী। একটি নাম, একটি আদশর্, একটি অহিংস মানবতাবাদী স্মরণীয়-বরণীয় চরিত্র। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়ক তিনি। তিনি ভারত ও বিশ্বজুড়ে মহাত্ম নামে পরিচিত। তিনি ভারতের জাতির জনক। তার পুরো নাম মোহনদাস করমচঁাদ গান্ধী। এই উপমহাদেশে এমন মানুষ খঁুজে পাওয়া দুষ্কর যে মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনেননি। আজ ২ অক্টোবর (১৮৬৯) তার জন্মদিন। গুজরাটের সমুদ্র উপক‚লীয় শহরে পোরবন্দরে তার জন্ম হয়। ভারতবাসী এই দিনটি ছুটির দিন হিসেবে পালন করে থাকে। তিনি সব সময়ে ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা তিনি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করেন তিনি। মানুষকে নিয়ে যান গণতন্ত্র ও মানবতার দিকে, সত্য ও ন্যায়ের দিকে। এই যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর পথে। আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে একমাত্র সত্যই সবার উপরের জিনিস। তাহা সাবের্ভৗম এবং তাহার ভেতরেই আমি অন্য সব নীতির সমাবেশ দেখিতে পাইয়াছি। এই সত্য কেবল সত্যবাদিতা নহে। ইহা যেমন বাক্যে তেমনি চিন্তাতেও। ইহা কেবল আমাদের উপলব্ধির আপেক্ষিক সত্য নহে, পরন্তু তাহা চিরন্তন সত্য, শাশ্বত সত্য, পরম সত্য। অথার্ৎ তাহা পরমেশ্বর।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যদি আমার লেখার মধ্যে পাঠকের কাছে আমার অহঙ্কারের সূ²তম সুরের আভাষও ধরা পড়ে তবে তাহারা অবশ্য জানিবেন যে আমার সাধনার মধ্যে ত্রæটি রহিয়া গিয়াছে।’ একজন মহান মানবের পক্ষেই এমন বিনয়ী উচ্চারণ সম্ভব। তিনি সত্যাগ্রহ ও অহিংসনীতি দ্বারা নিপীড়িত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলে ভারতবষের্র স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? ভারতবাসীকে মুক্তি দিয়েছিলেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। পৃথিবীর যেখানেই নিযাির্তত, নিপীড়িত মানুষের কান্না শুনেছেন, সেখানেই ছুটে গিয়েছেন গান্ধীজি। যেখানেই বণর্বাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রক্তপিপাসু রূপ নিয়েছে, সেখানেই তিনি প্রসারিত করেছেন শান্তির ও সাম্যের হাত। যেখানে মানবতার বিপযর্য় হয়েছে সেখানেই গিয়েছেন তিনি। কি আফ্রিকা, কি কলকাতা, নোয়াখালী, বিহারÑ সবর্ত্রই তিনি শান্তির পথ-প্রদশর্ক। বনেদি পরিবারে জন্ম তার। তার পিতা করমচঁাদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান। মহাত্মা গান্ধীর মা পুতলিবা। পুতলিবা পরম ধামির্ক মহিলা ছিলেন। মায়ের আদশর্ এবং গুজরাটের জৈন প্রভাবিত পরিবেশ থেকে গান্ধী তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা লাভ করেন। সবর্জীবে দয়া, অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস, সবোর্পরি অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গী মহাত্মা গান্ধী শৈশবেই আত্মস্থ করেছিলেন। ছাত্র হিসেবে মহাত্মা খুব মেধাবী না হলেও ১৮ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভাসিির্ট কলেজ লন্ডন ভতির্ হন। বিলেতে পড়তে পাওয়ার পঁাচ বছর পূবের্ই তিনি পারিবারিক সিদ্ধান্তে বাবা-মায়ের মনোনীত পাত্রী ১৪ বছর বয়স্কা কুস্তুরবা মাখাঞ্জীকে বিয়ে করেন। গান্ধী যখন দাম্পত্য-জীবন শুরু করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। মহাত্মা গান্ধী জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মহাত্মা হননি। এজন্য তাকে নিরন্তর সাধনা ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই সাধনায় কোনো ফঁাক বা ফঁাকি ছিল না, লোক দেখানোর কোনো হীনমানসিকতাও ছিল না। মহাত্মা গান্ধীর জীবন ছিল একেবারেই সাদামাটা। আহারে-বিহারেই শুধু নয়Ñ পোশাকেও তিনি খুবই সাধারণ ছিলেন। ব্যারিস্টারি পড়ার সময় পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাক পরিধান করলেও ভারতে এসে মহাত্মা ‘লেংটি আর চাদর’ ধরেছিলেন। তার পোশাক নিয়ে পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান মানুষই তাকে পরিহাস করেছেন। তাকে দেখেছেন হীন চোখে। তাতে কী তিনি চলেছেন তার নীতি-আদশর্ নিয়ে। তার নীতি-আদশর্ কমর্ ছড়িয়ে দিয়েছেন গণ-মানুষের মাঝে। অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা প্রসারিত করেছেন তিনি মানুষের মাঝে। মানবপ্রেম এর জয়গান গেয়েছেন তিনি সবসময়। তারপরেও তাকে আফ্রিকা ও ভারত মিলিয়ে মোট ১৩ বার কারাবরণ করতে হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় সাজা হয়েছিল ১৯২২ সালে। একটি পত্রিকায় ব্রিটিশবিরোধী প্রবন্ধ লেখার কারণে তার ৬ বছর কারাদÐ হয়। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে দুই বছর পরেই মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৪৭-এর পরের কালকে গান্ধীর জীবনের শেষ অধ্যায় বলে চিহ্নিত করা যায়। সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি ছুটে গেছেন সবর্ত্র। তিনি অহিংস আন্দোলন করলেও এই দাঙ্গা তিনি ঠেকাতে পারেনি। এই দাঙ্গা তাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে, মমার্হত করেছে। ভারতের স্বাধীনতা ও ভারতবাসীর মুক্তির জন্য মহাত্মা গান্ধী জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি চরকা কেটে ভারতের স্বরাজ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ গ্রন্থে তিনি আরো বলেছেন- ‘ ১৯০৮ সালের পূবের্ পযর্ন্ত আমি চরখা কি তঁাত দেখিয়াছি বলিয়া আমার স্মরণ হয় না। তাহা হইলেও আমার ‘হিন্দ স্বরাজ’ বইতে ভারত বষের্ চরখার সাহায্যেই দারিদ্র্য দূর করা যায়, ইহা আমি বলিয়াছি। আমি ধরিয়া লইয়াছিলাম, যে পথে দেশের ক্ষুধা মিটিবে সেই পথেই স্বরাজ আসিবে।’ তিনি ওই পথেই সফল হলেন। ভারতবাসীকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিলেন। বিদেশি পণ্য বজর্ন করে কেন তিনি চরকা কেটে স্বরাজ আন্দোলন শুরু করেছিলেনÑ তার ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করেছিলেন তিনি। রক্তপাতে কখনো বিশ্বাস ছিল না মহাত্মার। বিদ্বেষ বা হানাহানিতেও বরাবর তার অনাস্থা ছিল। অহিংস পথেও যে জয় নিশ্চিত হয় তা তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে তিনি নিহত হন। যতোদিন ভারত বষর্ থাকবে ততদিন মানুষের ভালোবাসা, ভক্তি ও শ্রদ্ধা অটুট থাকবে তার প্রতি। তারাপদ আচাযর্্য: কলাম লেখক