দেশ যেভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ

স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য সংকট, অভাব-অনটন ছাড়াও ছিল দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিভেদ, ছিল বিচারহীনতা, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস ও কালোবাজারি। তাতে সাধারণ মানুষের জীবন ছিল অতিষ্ঠ, দুর্বিষহ। এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সমাজ পরিবর্তনের কথা ভাবেন। 'দ্বিতীয় বিপস্নব' হিসেবে তিনি পাঁচটি কর্মসূচি দিয়েছিলেন- এর মধ্যে আছে অধিক উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি নির্মূল।

প্রকাশ | ১০ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

ড. জাহাঙ্গীর আলম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন এবং কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি বিপস্নবের ডাক দিয়েছিলেন। কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য তিনি উদার রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, '১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু।' অতঃপর বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এগিয়ে চলে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। দ্রম্নত অবকাঠামো গড়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় নতুন কর্মসংস্থান। ফলে কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়তে থাকে দেশজ উৎপাদন। কমতে থাকে দারিদ্র্য। বস্তুত, স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভয়াবহভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ত্রিশ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে হয়েছে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির মাধ্যমে। সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তাই তিনি বলেছিলেন, 'খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজের সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব।' সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপস্নবের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে তিনি কৃষি বিপস্নব বিকাশের কথা স্পষ্টভাবেই উলেস্নখ করেন। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে বঙ্গবন্ধু সরকার একদিকে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র ও উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করে; অন্যদিকে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের ব্যবস্থা করে। ধান, পাট, তামাক, আখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের নূ্যনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কৃষির উৎপাদনকে লাভজনক করে তোলা হয় দেশের কৃষকদের জন্য। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমাদের সমাজে চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।' দেশের কৃষি বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় তৎকালীন বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের শরিকানা ছিল ২০ শতাংশ। তার নেতৃত্বে প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষি ও পলস্নী উন্নয়ন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল কৃষি উন্নয়নের ওপর। গড়ে তোলা হয়েছিল বিভিন্ন গবেষণা, সম্প্রসারণ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির সব খাজনা রহিত করেন। জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। ওই জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। তাছাড়া আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তোলেন গুচ্ছগ্রাম। পাকিস্তান আমলের সব কৃষিঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা সব সার্টিফিকেট মামলা তিনি প্রত্যাহার করে নেন। কৃষিক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য কারিগরি গ্র্যাজুয়েটের (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার) অনুরূপ কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা নিশ্চিত করেন। তাদের টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতিও দেন। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য সংকট, অভাব-অনটন ছাড়াও ছিল দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিভেদ, ছিল বিচারহীনতা, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস ও কালোবাজারি। তাতে সাধারণ মানুষের জীবন ছিল অতিষ্ঠ, দুর্বিষহ। এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সমাজ পরিবর্তনের কথা ভাবেন। 'দ্বিতীয় বিপস্নব' হিসেবে তিনি পাঁচটি কর্মসূচি দিয়েছিলেন- এর মধ্যে আছে অধিক উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি নির্মূল। কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায়। বঙ্গবন্ধু আমাদের কৃষিব্যবস্থায় কৃষকের দারিদ্র্য এবং জমির খন্ডবিখন্ডতাকে উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাই তিনি কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তার ভাবনা ছিল প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে আধুনিক চাষাবাদ সহজ হবে। সম্ভব হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ সম্ভব হবে। তাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যাবে। এর মাধ্যমে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক ও যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের কৃষকরা সব ধরনের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের কৃষি উন্নয়নের গতি থমকে যায়। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়। দারিদ্র্য ও মহাজনি ঋণের চাপে নিষ্পেষিত হয় দেশের কৃষক। তবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর অবস্থার দ্রম্নত উন্নতি সম্ভব হয়। কৃষি খাতে সরকারি সমর্থন ও সহায়তা বেড়ে যায়। পুনঃপ্রবর্তন করা হয় কৃষিতে ভর্তুকি। তাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। গত ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে কৃষি খাতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়। একসময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছিল খাদ্যের অভাব। একজন শ্রমিক সারাদিন কাজ করে যে মজুরি পেত, তাতে তিন কেজি চাল কেনারও সামর্থ্য হতো না। গত ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৫৩ লাখ টনে। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল, সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল তিন কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। এখন না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য, মাছ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ম্ভর। আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। মাছ রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। জমির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতি বছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষি জমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তার পরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের; বরং বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রম্নত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। সাম্প্রতিককালে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষি খাতে। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপস্নব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে। এর পেছনে প্রধান সহায়ক শক্তি শেখ হাসিনা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, প্রণোদনা ও সহায়তা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার কৃষি উন্নয়নের যে উদার নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন, এ তারই ধারাবাহিকতা। ড. জাহাঙ্গীর আলম : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা