বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা

নতুনধারা
  ১০ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪ জন নিহত হয়। আর এই সংখ্যা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছিল। ২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে জরিপটি করেছিল তারা। গত বছর সাধারণ ছুটির (অঘোষিত লকডাউন) আগের মাসে ফেব্রম্নয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩৪ জনের মৃতু্য হয়েছিল। পরিপূর্ণ লকডাউন (অঘোষিত) অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য হয় ১৩০ জনের। অর্থাৎ ফেব্রম্নয়ারির তুলনায় এপ্রিলের দুর্ঘটনায় মৃতু্য হ্রাস পেয়েছিল ৭৬%। সাধারণ ছুটির পর দেশ যত স্বাভাবিক হয়েছে দুর্ঘটনা ততই যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে সামনে আরও ভয়াবহতা বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) হিসেবে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২১,০০০ লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৫৮ জনের মৃতু্য হয়। ২০১৮ বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষায় জাতীয় কমিটি (যাত্রী কল্যাণ সমিতি) তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-তে ৬০৪৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৭৯৬ জনের প্রাণহানী হয়েছে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ২১ জনের মৃতু্য হয়েছে। ২০১৯ সালে তা আরও বেড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮৫৫ জনে। প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর সংখ্যা সবচেয়ে কম সরকারি হিসেবে, তাও প্রায় ৯ জন। সবচেয়ে কম সরকারি হিসাব ধরলেও দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর সংখ্যা প্রায় পৌনে এক লাখ। অথচ দুই দশকের যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধে প্রাণ হারায় অর্ধলাখ মানুষ। তাই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য, যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য মহামারির একদিনের মৃতু্যর প্রায় দ্বিগুণ। 'বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম গাড়ি ব্যবহার করেও সর্বাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ হতাহত হয় তা দেশের সব অপরাধী কর্মকান্ড মিলিয়েও হয় না। তারপরও বছরের পর বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনা কমার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি ব্যবহার করেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। আর সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যুক্তরাজ্যে। প্রতি বছর বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় দেড় লক্ষাধিক লোকের মৃতু্য হচ্ছে এবং আহত হচ্ছে আরও পাঁচ কোটি মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় আগে শীর্ষে ছিল নেপাল। নেপাল সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এখন দ্বিতীয় স্থানে চলে আসায় বাংলাদেশই প্রথম স্থানে চলে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনার ওপর ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন, ইউএনইসিই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্যের উলেস্নখ করে বলা হয়েছে' (তথ্যসূত্র-জনকণ্ঠ) যদিও সব মৃতু্যর যন্ত্রণা একই ধরনের তবে সব মৃতু্যর মূল্য বা প্রভাব একই ধরনের না!! বিভিন্ন মৃতু্যর রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিভিন্ন ধরনের। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২০০০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় অর্থাৎ প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যায় ৩২ শিশু, নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বস্নুমবার্গ ফিলালথ্রপিসের অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (ঈওচজই) এবং আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্রে (ওঈউউজই) যৌথ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যকে পৃথিবী যেভাবে মূল্যায়ন করছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও পানিতে ডুবে তার চেয়েও বেশি মানুষের মৃতু্য কি পৃথিবী সেভাবে মূল্যায়ন করছে? সড়ক দুর্ঘটনা বা পানিতে ডুবে মৃতু্যগুলো আমাদের মনে নাড়া দেয় না কেন, আমি জানি না? সম্ভবত এই মৃতু্যগুলো আমাদের কাছে প্রভাবহীন অথবা আমরা এগুলোর ব্যর্থতা মেনে নিয়েছি। গণমাধ্যম কি এই মৃতু্যগুলোকে করোনাভাইরাসের মতো প্যানিক তৈরি করতে পেরেছে? আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় এখন চরম বিশৃঙ্খলতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশের ৭০% সড়ক ব্যবহার করছে মাত্র ৫% গাড়ি মালিকদের ব্যাক্তিগত গাড়ি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) তথ্যমতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর ৩২% নিরীহ পথচারী অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পথচারী মৃতু্যহার মাত্র ৯% এবং ভুটানে মাত্র ৩%। সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রী মৃতু্যহার ৪১% এবং চালক মৃতু্যর হার ২৭% এবং বাকী ৩২% পথচারী। বৈশ্বিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর ৯০% হয় অনুন্নত দেশে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬৫% লোকই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যারা জীবিকার জন্য রাস্তায় বের হয়, যার ধরুন তার মৃতু্যতে সম্পূর্ণ পরিবারটি পথে বসে যায় (সূত্র : ঞযব উধরষু ঝঃধৎ)। উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত ব্যক্তির প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি/পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সড়ক ও পরিবহণ ব্যবস্থা এখন একটি ভয়ঙ্কর মৃতু্যর ফাঁদ। প্রতিদিনই এই ফাঁদে পড়ে নিরীহ মানুষের পাশাপাশি মৃতু্যবরণ করছে বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, জাতীয় দলের খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, জজ, ব্যারিস্টার এমনকি রাষ্ট্রদূতও অর্থাৎ প্রায় সব পেশার মানুষই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর মিছিলে সামিল হয়েছে। এত লাশ, এত মৃতু্যর পরও ভয়ঙ্কর এই মৃতু্য ফাঁদটি সংস্কার না হয়ে বরং দিন দিন আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে। আর কত বড় মাপের মানুষ বা আর কত লাখ নিরীহ মানুষের লাশ পড়লে আমরা এর থেকে উত্তরণের পথ পাব জানিনা।

নাজমুল হক

ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে