ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বাঙালিদের জন্য ইলিশ একটি জনপ্রিয় মাছ। ইলিশ মাছ স্বাদে সমৃদ্ধ নয় এটি দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে ও সমৃদ্ধ। শুধু তাই নয়- ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃত ইলিশের স্বাদ, রূপ ও ঘ্রাণ এদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। ইলিশ মাছ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশ ইলিশ মাছ চাষের জন্য যুগ যুগ ধরে বিখ্যাত। বর্তমানে ইলিশ স্বীকার, সংরক্ষণ, বিপণন ও বিক্রয় কাজে দেশে প্রায় ২০ লাখ মৎস্যজীবী ও মাছ ব্যবসায়ী নিয়োজিত। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ইলিশ উৎপাদিত হয়। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৫০ হাজারে মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮৬% ইলিশ আমাদের দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের সর্বমোট মৎস্য উৎপাদনের শতকরা প্রায় ১২.৪৫ ভাগ ইলিশ। বর্তমানে বাংলাদেশের উৎপাদিত ইলিশ ইউরোপ-আমেরিকাসহ, এশিয়া মহাদেশের অসংখ্য দেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হচ্ছে, পাশাপাশি বিশ্বের পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত একটা গর্বের বিষয়। সাধারণত ইলিশ সামুদ্রিক মাছ। গভীর সমুদ্র থেকে এ মাছ ডিম পাড়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারতের নদীগুলোতে আগমন করে। তারপর মা ইলিশগুলো বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ কতগুলো বড় বড় নদীতে উজান স্রোতে প্রবাহে ডিম ছাড়ে। ডিমগুলো ভাসমান এলাকায় দিয়ে ৬ থেকে ১০ সপ্তাহের পর এই মাছ বাইরে থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এ জাটকাগুলো আরও বড় হওয়ার জন্য গভীর সমুদ্রে দলবেঁধে পাড়ি দেয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক এই মাছগুলোকে জাটকা ইলিশ বলা হয়। এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক মাছগুলো বৃদ্ধি হওয়ার প্রাক্কালে কিছু অসৎ জেলে সমুদ্র থেকে মাছ ধরার জাল দিয়ে জাটকাগুলো ধরে বাজারজাত করে। বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ইলিশ বড় হওয়ার মৌসুমে সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রায় ৩৪০০-৪০০০ মেট্রিক টন জাটকা ধরা পড়ে। বর্তমানে বাজারসহ ভ্রাম্যমাণ মাছের বাজারগুলোতে জাটকার ক্রয়-বিক্রয় বেশ লক্ষণীয়। মৎস্য আইনানুযায়ী জাটকা স্বীকারের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও জেলেরা প্রচুর জাটকা ইলিশ ধরছে। তাই বলা যায়, প্রতি বছর বড় বড় নদীতে জাটকা নামে পরিচিত সমুদ্রগামী অপ্রাপ্ত বয়স্ক (৬-১০) সেন্টিমিটার মাছগুলো প্রচুর পরিমাণ ধরা পড়ে যা ইলিশ মাছের ভবিষ্যৎ উৎপাদনের জন্য খুবই ক্ষতিকর একটা বিষয়। সাধারণত ২৩ সেন্টিমিটার/ ৯ ইঞ্চি নিচে ইলিশকে জাটকা বলা হয়। এই জাটকা ইলিশগুলো কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতার না থাকলে ৬০ সেন্টিমিটার আকার অর্থাৎ প্রায় ২.৯ কেজি ওজন হয়। এসব বড় আকারের মাছগুলোর স্বাদ খুবই ভালো এবং দেশের রপ্তানি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত গত জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ-২০২১ এ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন;- জাটকা ইলিশ সংরক্ষণে সমন্বিত উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর। মুজিববর্ষের শপথ নেব, জাটকা নয়, আমরা ইলিশ খাব। তাই বলা যায় বর্তমান সরকার জাটকা ইলিশ সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। তবুও সরকারের একার পক্ষে রাতারাতি জাটকা ইলিশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জনগণ যদি সরকারের সঙ্গে জাটকা ইলিশ সুরক্ষায় কাজ করে যায় তাহলে দেশের জাটকা সুরক্ষা শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জাটকা ইলিশ সুরক্ষা নিশ্চিত হলে ইলিশের উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে, মাছের ন্যায্যমূল্য থাকবে, ইলিশ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। বর্তমানে মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে আমাদের দেশে অনেকটা সাফল্য এসেছে। এই সফলতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে, সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের উচিত দেশের সর্বোপরি দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য জেলেদের জাটকা ধরার কাজে নিরুৎসাহিত করা এবং নিজেরাই বাজার থেকে জাটকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করা। ফলে বাজারে জাটকার চাহিদা না থাকলে, জেলেদের জাটকা ধরার প্রবণতা অনেকটা কমে যাবে। সরকার প্রতিবছর মৎস্যজীবীদের জাটকা না ধরার লক্ষ্যে, তাদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে সরকার ইলিশ পরিভ্রমণ পথকে সুরক্ষার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ৩,১৮৮ বর্গকিলোমিটার জলসীমাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, সমুদ্রে ৬৫ দিন সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ কার্যক্রম, জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম, সম্মিলিত বিশেষ অভিযান পরিচালনা, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষিত জনগণের উচিত জাটকা ধরার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি অশিক্ষিত মৎস্যজীবীদের জন্য সরকারের প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা এবং জাটকা ইলিশ না ধরা ও ইলিশ অভয়াশ্রমের জন্য যে রাষ্ট্রীয় মৎস্য আইন ও কার্যক্রমগুলো চলমান, সেগুলো সম্পর্কে জেলেদের অবহিত করা উচিত। তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করব জাটকা সংরক্ষণে সারাদেশে সরকারের দেওয়া পদক্ষেপগুলো মেনে চলে ইলিশ উৎপাদিত অঞ্চলগুলোতে গণসচেতনা বৃদ্ধি করুন। সর্বস্তরের জনগণকে মনে রাখা উচিত, আজকের জাটকাই আগামী দিনের পরিণত ইলিশ।
আসাদুজ্জামান সম্রাট
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, চবি