পাঠক মত

কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
করোনার থাবায় বিশ্বজুড়ে চলছে লকডাউন। থমকে গেছে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা, স্থবির হয়ে পড়েছে কর্মচঞ্চল মানুষের জীবনধারা। বন্ধ হয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব ব্যবসা-বাণিজ্য। এমন পরিস্থিতিতেও মাঠে কাজ করছেন কৃষক। করোনা এখনো দেশের কৃষি ও কৃষককে থামাতে পারেনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডকে মেরামতের কাজে ব্যস্ত তারা। ক্ষেতের ফসলে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে, স্বপ্ন বুনতে থাকেন আগামীর পথ চলার। কিন্তু করোনার চোখ-রাঙানি আর আগ্রাসনে কৃষকের সেই হাসি কালো মেঘের আড়ালে ঢেকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সুখের স্বপ্নে হানা দিয়েছে দুর্ভাবনা। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। মানবজাতির আদিমুম পেশা হচ্ছে কৃষি। আমাদের কৃষক সমাজ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের খাদ্য জোগান দেন কৃষকরা। বাংলার কৃষক হচ্ছে বাংলার কৃষির প্রাণকেন্দ্র। তাই আমরা বলি কৃষকই জাতির মেরুদন্ড। এদেশের প্রায় ৮০% লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বিরাট অংশ আসে কৃষি খাত থেকে। তাই বাংলাদেশর অর্থনীতি কৃষির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বাংলার এই কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলার কৃষকরা। কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ঘোরে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য এদেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখে। তাই তো কবি বলেছেন, 'সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা!' বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক নিবিড়। এদেশের খেটে খাওয়া জনসাধারণ প্রখর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে। আর এই ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকরা অথবা আমরা সাধারণ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করি। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এদেশে ভরে ওঠে ফসলের সমারোহ। যা থেকে আমরা পাই ক্ষুধার অন্ন। কৃষি উৎপাদনে কৃষকের ভূমিকা অনেক বেশি। কৃষকের উৎপাদিত ফসলই দেশের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদন করে দেশসেবার কাজে কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন, তা তারা কখনোই প্রচারের চেষ্টা করেন না। তারা নীরবেই কাজ করে যান। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ফলানো ফসল আমরা খাই। শুধু ধান নয়, সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। কৃষককুলের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এদেশের অর্থনীতি। জাতীয় আয় সৃষ্টিতে কৃষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য একদিকে যেমন দেশের মানুষের চাহিদা মেটায়, তেমনি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। তাই এদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো বাংলার কৃষি ও কৃষক। বাংলাদেশের কৃষকরা অতি সহজ ও সরলভাবে জীবন-যাপন করে। তাদের জীবনের একমাত্র সম্বল হালের গরু পুরাতন ভোঁতা কৃষি যন্ত্রপাতি। তারা ভাগ্যের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখে কাজ করে যায়। সারাদিন মাঠে কাজ করতে ভালোবাসে। প্রখর রোদ, বৃষ্টি তাদের কাবু করতে পারে না। মাঠভরা ফসল দেখলে তাদের মুখে হাসি ফোটে আনন্দে মন নেচে ওঠে। খাদ্যদ্রব্য ও নিু্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদি ও এদেশের অধিকাংশ খাদ্যের জোগানদাতা কৃষক। কৃষকরা কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে যেমন বেকারত্বের হার হ্রাস পাচ্ছে, ঠিক তেমনি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষকের ভাগ্যের সঙ্গে এদেশের অগণিত মানুষের ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যাসহ বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এর ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আমাদের দেশের কৃষকরা প্রতি বছরই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটা ধাক্কার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই, আবার খরচ অনুযায়ী ফসলের দাম না পাওয়া সব মিলিয়ে কৃষকের কষ্ট সারা বছর থেকেই যায়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ভাষায়;- ক্ষেতে ক্ষেতে পুইরা মরি, রে ভাই পাছায় জোটে না ত্যানা, বৌ-এর পৈছা বিকায় তবু ছেইলা পায়না দানা। সত্যিই কৃষকের পাছায় ত্যানা জোটে না- কেন না বর্তমান সময়ে কৃষিকাজের যা খরচ সে অনুযায়ী ফসল বিক্রি করে উপার্জন করতে পারেন না আমাদের কৃষকরা। আবার যারা বর্গাচাষ করেছিলেন তাদের তো আরও দুরবস্থা। সাধারণত প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে ও মাড়াই করতে কৃষি শ্রমিকদের দিতে হয় ২৫০০-৩০০০ টাকা। এ ছাড়া সার, ওষুধসহ অন্যান্য বাবদ প্রতি বিঘা জমি চাষ করতে মোট খরচ হয় ৮-১০ হাজার টাকা। দুঃখ, বেদনা, দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করে তারা যেভাবে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করে যাচ্ছে তার তুলনা নেই। সে জন্য এদেশের উন্নতি করতে হলে প্রথমে কৃষকদের উন্নতি সাধন করতে হবে। কৃষকই জীবন! কষকই জাতির মেরুদন্ড। কৃষকই এদেশের প্রাণশক্তি। এই কৃষির ওপর চলে কৃষকের জীবন, তার পরিবার। সারা বছরের খরচ, এমনকি কৃষকের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ অন্যান্য আরও অনেক খরচ। এতে যদি কৃষক সঠিক দাম না পান, তা হলে তাকে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। জীবন-জীবিকার জন্য এ দেশের জনগণ ও অর্থনীতি মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষি উৎপাদন বিপর্যস্ত হলে দেশের সামাজিক অর্থনীতি বিপন্ন হয়ে পড়বে। মাটি থেকে ফসল ফলানো এই মাটির মানুষকে নিয়ে কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী যথার্থ বলেছেন, সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা। সত্যিকার অর্থেই দেশের সেরা সাধক এই কৃষিকাজ করা মানুষ। কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে হলে কৃষি খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে কৃষি খাতের ক্ষতিপূরণ করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগও হাতে নিয়েছে সরকার। প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তা কতটুকু কৃষক বরাবর পৌঁছাচ্ছে সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে। কেউ যেন এটা নিয়ে ছ'কড়া ন'কড়া করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ধানের দাম কম থাকলেও চালের দাম কখনো কম হয় না। অতিরিক্ত মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা মাল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট যাতে তৈরি করতে না পারে সেদিকে সরকারকে কড়াকড়িভাবে নজর দিতে হবে। কৃষক যেন ফসলের ন্যায্যামূল্য পায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে অথচ এদেশের কৃষকের অবস্থা এখন নাজুক। তাদের সামাজিক মর্যাদা নেই বললেই চলে। এই জন্য শিক্ষিত নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। যে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী শহরে বসে কৃষকের ভাগ্য নির্ধারণ করেন তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে গৃহীত সময়োচিত পদক্ষেপই জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাই এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ। অধিক জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এদিকে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষকরা কৃষিকাজে আর উৎসাহ পাচ্ছেন না। নিরুপায় হয়ে গেছে কৃষক সমাজ। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আমাদের কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। কৃষকের উন্নতি মানে আমাদের দেশের উন্নতি। কৃষকের ক্ষতি মানে দেশ ও দশের ক্ষতি। কৃষকরা না থাকলে আমরা কেউই প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টি নিজেরদের শরীরে ধারণ করে স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে পারতাম না তাই প্রকৃতি ভালোবাসার সঙ্গে ওনাদের সম্মানও ভালোবাসতে হবে। এই উপলব্ধি থেকে সরকারকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে বাংলার কৃষকদের বাঁচাতে। সিনথিয়া সুমি শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-গোপালগঞ্জ