আসুন সংযমের মাসে সংযত হই

রহমত, বরকত ও নাজাতের এই মাসে আমরা আক্রমণাত্মক নয়, সংযত হই, বিনয়ী হই, পরোপকারী হই এবং আমাদের সংযমের মাধ্যমে অপর ভাইবোনের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করি।

প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে এসেছে মাহে রমজান। এই রমজান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমাদের জন্য অপরিমেয় অর্থাৎ যার পরিমাপ করা যায় না। মাহে রমজান মাস মুসলিম উম্মার জন্য কতটা পুণ্যের তা রাসূলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামের প্রস্তুতি থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। মাহে রমজান আগমনের দুই মাস আগেই রাসূলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম প্রস্তুতি শুরু করে দিতেন। রজবের শুরুতেই নিজে এবং সাহাবায়ে কিরামকে এ দোয়া করার জন্য বলতে 'আলস্নাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বালিস্নগনা রামাদান।' (হে আলস্নাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় কর এবং আমাদের রমজানের পুণ্যময় মাস অর্জনের সৌভাগ্য দান কর।) তাবারানি, বায়হাকি। রাসূলুলস্নাহ (সা.)-এর এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বের মুসলমানরা রমজান আসার আগেই পবিত্র রমজান মাসের জন্য প্রতি বছর প্রস্তুতি শুরু করে দেন। সাহাবায়ে কিরামের পর তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়িন, মুহাদ্দিসিন, আইম্মায়ে মুজতাহিদিনসহ সর্বস্তরের মুসলমান নিজ নিজ পরিসরে রমজানের প্রস্তুতি নিয়ে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয়, এই পবিত্র রমজান মাস মুসলিম উম্মার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে একটা বিষয় প্রতি বছর লক্ষ্য করি, তাহলো- রমজান মাসে হাটেবাজারে, পথেঘাটে সর্বত্র কতিপয় লোক চট করেই রেগে যান। সোরগোল বাঁধিয়ে ফেলেন, যাতে ছোট ঘটনা থেকে বৃহৎ ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। তারা এ কথা ভুলে যান যে, তারা রোজাদার। আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব, একথা মনে রাখা যে, আমরা রোজাদার। অপরের সামান্য ভুলের জন্য রমজান মাসে ঝগড়া করা কোনোমতেই উচিত হয়। আমাদের রাগ হলে অবশ্যই মাটির দিকে নজর দিতে হবে এবং মনে মনে বলতে হবে- আমি রোজাদার, আমি রোজাদার। এ মাসে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই কর্তব্য। কারণ রোজা আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। রোজা শুধু বর্তমান জামানায় নয়, বর্তমান নবী করিম (সাঃ) দুনিয়াতে আগমনের বহু পূর্ব থেকেই বিভিন্ন নবীর উম্মতের ওপর রোজা ফরজ ছিল। এ প্রসঙ্গে মহান আলস্নাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, 'হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে তোমরা আত্মসংযমের নীতি (তাকওয়া) অর্জন করতে পার। নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন, 'এ মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খোলা থাকে আর দোজখের দরজাগুলো বন্ধ থাকে এবং শয়তানকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়।' বুখারি, নাসায়ি। তারপরও আমরা লক্ষ্য করে থাকি হাটেবাজারে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরতলীতে রাস্তার পাশে অনেক হোটেল মালিকরা তাদের হোটেল পর্দা দিয়ে ঘিরে জনগণের খাওয়ার জন্য জায়গা করে দেয় এবং অনেক মানুষ দিনে-দুপুরে সেখানে গিয়ে খাওয়ার কাজটি করে যায় সংগোপনে। শয়তানকে শিকল পরিয়ে রাখা সত্ত্বেও এসব জনগণ শয়তানের শয়তানি থেকে রক্ষা পায় না, তার মানে তাদের অন্তর ভীষণভাবে কলোষিত। আলস্নাহর ভয় তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। এসব লোকের চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে! আবার অনেক স্থানে দেখা যায়, দিন-দুপুরে জনগণের সামনে অনেকে এটা সেটা খাচ্ছে। এরা একাধারে গুণাহ তো করেই যাচ্ছে তার উপরি রোজার পবিত্রতা নষ্ট করছে। আবার এমনও হতে পারে এদের দেখে কোমলমতি, উঠতি যুবক-যুবতিরা রোজা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আল কোরআনে আলস্নাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, যে এ মাস পাবে সে যেন রোজা রাখে। তাতে সে মুত্তাকি বান্দায় পরিণত হয়।' সূরা বাকারা : ১৮৩ ও ১৮৫)। সব কুপ্রবৃত্তি ও রিপু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেরেশতা-সুলভ আচরণের দামি মানুষটি তৈরি করতে মূলত রমজানের আগমন। খনি থেকে বের করে আনা সোনা আগুনে পোড়ালে যেমন খাদ থেকে মুক্ত হয়ে সোনায় সোনালি রং ফুটে ওঠে, গাছ পুড়ে কয়লা হয় আর কয়লা পুড়লে ডায়মন্ড (হীরক) খন্ড তৈরি হয়, তেমন রমজানের দাহনে সিয়াম সাধক গুনাহ থেকে অবমুক্ত হয়ে কুরিপু ও গ্রন্থিগুলো ধ্বংস হয়ে সোনালি জান্নাতি মানুষে পরিণত হয়। রমজান মাসে নাজিল করা হয়েছে (মহাগ্রন্থ) আল-কোরআন, মানব জাতির হেদায়েতের জন্য এ গ্রন্থখানা সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। মুমিনের আত্মাকে আলস্নাহতায়ালা ধুয়ে-মুছে পাক-সাফ করে তার রঙে রঙিন করে তুলবেন। আর যারা আলস্নাহপ্রেমিক তারা শুধুই ভাবছেন, কোন দিন শুরু হবে রমজান এবং কীভাবে তারা নিজেদের পূত-পবিত্র করে গড়ে তুলবেন এ মাসে। তাদের আখলাককে উন্নততর, মহত্তর, পবিত্রতর করে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ সাধন করবেন। চারিত্রিক গুণাবলি আরও শানিত করবেন। সিয়াম সাধনার কঠোর সংযমের সিঁড়ি বেয়ে পরহেজগারির শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করবেন। জীবনের যে কোনো বিষয়ে সফলতা আনতে চাইলে অথবা কোনো বিষয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করলে তার প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজের মন-মানসিকতাকে স্থির করা ও গোছানো এবং এর জন্য প্রস্তুতি শুরু করা। মাহে রমজান এমনই এক বরকতময় মাস, যার আগমনে পুলকিত হয়ে স্বয়ং রাসূলুলস্নাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কিরামদের মোবারকবাদ পেশ করতেন। তিনি সাহাবিদের এ মর্মে সুসংবাদ প্রদান করেছেন যে, 'তোমাদের সামনে রমজানের পবিত্র মাস এসেছে, যে মাসে আলস্নাহ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন।' নাসায়ি, আহমদ। রাসূল (সাঃ) একদা শাবান মাসের শেষ দিনে সাহাবায়ে কিরামকে লক্ষ্য করে মাহে রমজানের রোজার ফজিলত সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে ইরশাদ করেন, 'হে মানবগণ! তোমাদের প্রতি একটি মোবারক মাস ছায়া ফেলেছে। এ মাসে সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম একটি রজনী আছে, যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। যে ব্যক্তি এই মাসে কোনো নেক আমল দ্বারা আলস্নহর সান্নিধ্য কামনা করে সে যেন অন্য সময়ে কোনো ফরজ আদায় করার মতো কাজ করল। আর এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো ফরজ আদায় করে সে যেন অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আদায়ের নেকি লাভ করার সমতুল্য কাজ করল। এটি সংযমের মাস আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত।' বায়হাকি, ইবনে খোজাইমা। রহমত, বরকত ও নাজাতের এই মাসে আমরা আক্রমণাত্মক নয়, সংযত হই, বিনয়ী হই, পরোপকারী হই এবং আমাদের সংযমের মাধ্যমে অপর ভাইবোনের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করি। মো. মাঈন উদ্দিন : কলাম লেখক