বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লকডাউনে কী হবে গরিব মানুষের?

রেজুয়ান রিজভী শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

বর্তমানে এশিয়া মহাদেশের অর্থনীতির নতুন টাইগার বা বাঘ বলা হয় বাংলাদেশকে। উলেস্নখযোগ্য হারে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক জরিপে বলে এই বছর বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে। করোনা মহামারির মধ্যে এটা সত্যি অনেক বড় একটা খবর ছিল বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু এই করোনাই সব থেকে বাজে অবস্থায় ফেলেছে বাংলাদেশের দরিদ্রতাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানে দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়া। উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না হলেও হ্রাস পাচ্ছিল দরিদ্রতা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্যের দিকে তাকালে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। ২০১৬ সালে দরিদ্রতার হার ছিল ২৪.৩০ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২১.৬০ শতাংশে। পরিসংখ্যান বু্যরোর ২০১৯ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে দরিদ্রতার হার ২০.৫ শতাংশ, অতি দরিদ্র্যতার হার ১০.৫ শতাংশ। সন্তোষজনক হারেই কমতে ছিল দরিদ্রতা। ঠিক তখনই সারাবিশ্ব অদৃশ্য এক শত্রম্নর মুখোমুখি হয়। স্থবির হয়ে পড়ে পুরো পৃথিবী। প্রায় সব দেশের অর্থনৈতিক অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বাংলাদেশেরও যে এই শত্রম্নর জন্য অনেক বড় ক্ষতি করেছে তা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) দরিদ্রতা নিয়ে প্রকাশিত জরিপের দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায়। এখানে ২০২০ সালের দরিদ্রতার হার বলা হয়েছে ৪২ শতাংশের উপরে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে দরিদ্রতার হার কমেছিল ৪.২৫ শতাংশ তার ঠিক এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে।

গত বছরের শেষের দিক থেকে নতুন বছরের মার্চ মাস পর্যন্তও স্বাভাবিক হলেও গত বছরের প্রথম ঢেউয়ের কয়েকমাস সব বন্ধ থাকায় অনেক মানুষ কর্ম হারিয়েছে। অনেকের আয় কমেছে। অনেকে নিঃস্ব হয়েছে। এখন আবার লতডাউন চলায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এইটাই দরিদ্রতা বৃদ্ধির আসল কারণ। দরিদ্রতা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি এগুলাকে বিবেচনা করা হয়।

করোনা মহামারি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক মন্দাও সৃষ্টি হয়েছে। এই দুটি দিক বিবেচনায় দেশে দরিদ্রতা অনেক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনায় আপেক্ষিক দরিদ্রতাও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আপেক্ষিক দরিদ্রতা বলতে বোঝায় : স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে একজন অপেক্ষা আরেকজনের আয় অনেক বৃদ্ধি পাওয়া বা একজন সাপেক্ষে আরেকজন নূ্যনতম জীবনযাত্রার মান অর্জনে ব্যর্থ হওয়া। আপেক্ষিক দরিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ সরকারি চাকরিজীবীদের আয়ের কোনো ঘাটতি হয়নি তারা আগের মতোই আয় করতে পেরেছে কিন্তু বেসরকারি বা আত্মকেন্দ্রিক সংগঠন থেকে আয় করত তাদের আয় অনেক কমে গিয়েছে। এটা আপেক্ষিক দরিদ্রতা বৃদ্ধি করেছে, আগে থেকে দরিদ্র থাকা মানুষের সংখ্যা অনেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে করোনা কিছুটা কমায় সবাই নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। কিন্তু তাতেও বাধা হলো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এই ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের থেকেও অনেক বেশি ভয়ংকর। গত বছরের প্রথম ঢেউয়ের থেকে দ্বিগুণ আকারে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৫ এপ্রিল তারিখ থেকে ৭ দিনের লকডাউনের ঘোষণা করে সরকার। লকডাউন ঢিলেঢালাভাবেও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সরকার কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েই ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ থেকে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে। এতে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকসহ জরুরি সেবার আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বাদে সব বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য পরে ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এতে আবারও নতুন করে কর্মহীন হয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষ। বিশেষ করে একমালিকানা ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, শ্রমিক এমন আরও অনেক গরিব মানুষ। এই লকডাউন দরিদ্রতা অনেক হারে বৃদ্ধি করবে এটা অনিবার্য।

দরিদ্রতা দূরীকরণে সরকারের আগে থেকে কিছু ভূমিকা প্রশংসার দাবিদার। যেমন- গৃহহীনদের জন্য ঘর, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য আরও কিছু প্রকল্প। এর সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও দরিদ্রতা দূরীকরণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। করোনায় হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া এই দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে না পারলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব কিনা এই সন্দেহটা থেকেই যায়। এখন সরকারের উচিত হবে গত বছরের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এই বছর ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনা। একান্ত কর্মহীনদের সুনির্দিষ্ট একটু তালিকা করে তাদের সহযোগিতা করা। দীর্ঘমেয়াদিভাবে এই সমস্যা সমাধানে কতিপয় কিছু সমস্যা সমাধান করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন- দুর্নীতি, কর ফাঁকি, ঋণ, ঋণের শর্ত, বাস্তবমুখী শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। এসব কারণ শুরু থেকে দরিদ্রতা কমাতে বাধার সৃষ্টি করছে। তবু আমরা আশাবাদী সরকার এসব কারণগুলো বিবেচনায় নিয়ে বর্তমানে স্বল্পমেয়াদি এবং পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রথমবারের থেকে দ্বিতীয়বার অনেক স্বচ্ছভাবেই এসব কর্মহীন মানুষের সহযোগিতায় সরকার ও বেসরকারি সংস্থা, সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবে। করোনার বিপক্ষে মানবিকতাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একাত্তরের মতো আরেকটি বিজয় আমরা পাবো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে