টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা

প্রকাশ | ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

ইত্তেখারুল ইসলাম সিফাত শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরেই বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও, একইসঙ্গে কমেছে দারিদ্র্যের হার। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এখন আমরা সেই তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে এসে পৌঁছেছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি ও ভৌত অবকাঠামো ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ ঈর্ষান্বিত। এমডিজি বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। তবে যে বিষয়টি এখন সজোরেই আলোচনা হচ্ছে তা হলো, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য পরিবেশগত ভারসাম্যের বিনষ্ট হওয়া, আমাদের কেবল হতাশই করে। টেকসই উন্নয়ন বলতে ওই সব উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে বোঝায়, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও নিশ্চিত হয়, একই সঙ্গে প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রেও (ইকোসিস্টেম) তা কোনো প্রকার বিরূপ প্রভাব ফেলে না। তবে বাংলাদেশে যেভাবে টেকসই উন্নয়নের জায়গা থেকে সরে এসে পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থা নষ্ট করে, যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে, তা আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতিকে ভয়ানক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পৃথিবীর ১৮০টি দেশের মধ্যে পরিবেশ রক্ষা সূচকে আমাদের অবস্থান ১৭৯তম! এনভায়রনমেন্টাল পারফমমেন্স ইনডেক্সের (ইপিআই) ২০১৮ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল এ তথ্য। এ ছাড়া এই বছর আমাদের ঢাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় দূষিত শহরের খেতাবও পেয়েছে। আর্থ ডে নেটওয়ার্কের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে পস্নাস্টিক দূষণে আমরা বিশ্বে দশম। ২০০২ সালে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও তা দস্তুরমতো অনেকটা প্রকাশ্যেই ব্যবহার হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের প্রায় ৮০ ভাগ ড্রেন পলিথিন ব্যাগ কর্তৃক জমাট বেঁধে আছে। এর ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে সৃষ্টি হয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। আমরা আমাদের নদীগুলো ভরাট করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করছি, নদীর নাব্যতা ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। ধলেশ্বরী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। বুড়িগঙ্গাকে তো অনেক আগেই দূষিত করে রেখেছি আমরা; অন্য নদীগুলোর অবস্থাও একই। আট বছরে পরিবেশ সূচকে আমরা পিছিয়েছি ৪০ ধাপ (ইপিআই ইনডেক্স)। আমাদের কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, বনভূমি উজাড় করে আমরা শিল্পকারখানা স্থাপন করছি। বাংলাদেশ মৃত্তিকা উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে যেভাবে কৃষি জমি অকৃষিকাজে যাচ্ছে তাতে করে ২০৭০ সাল নাগাদ দেশে কোনো কৃষি জমি থাকবে না। এখানে একটি কথা বলা বাঞ্ছনীয়, পৃথিবীর কোনো দেশই তার টেকসই কৃষিব্যবস্থা নিশ্চিত না করে শিল্পে এগোতে পারেনি। আমরা শিল্পকারখানা নির্মাণে মনোযোগী হচ্ছি পরিবেশগত সুরক্ষাকে প্রাধান্য না দিয়েই, যা হতে নির্গত সিএফসি গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য অন্যতম দায়ী। অন্যদিকে পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র যা শীর্ষ কার্বন নিঃস্বরণকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত, তা আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ দেশে তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে পৃথিবীর অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসার ঘোষণা দিচ্ছে, সেখানে ইতিমধ্যেই আমরা মোট ২১টি কয়লা পস্ন্যান্টর চুক্তি করে ফেলেছি (বিদু্যৎ বিভাগের তথ্যমতে)। মার্কেট ফোর্সেস ও থ্রি ফিফটির যৌথ গবেষণা, ২০১৯-এর তথ্যমতে, এতগুলো কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্র চালু হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইডের কবলে পড়বে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইনেরও কার্যকর প্রয়োগ হচ্ছে না। যত্রতত্র স্থাপনকৃত ইটভাটার ধোঁয়া প্রতিনিয়ত পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। জাতিসংঘের ধারণামতে, ইটভাটার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়। এসব পরিবেশ বিরুদ্ধ কর্মকান্ড মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগ যেমন- ক্যান্সার, হৃদরোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমার ও স্নায়বিক দুর্বলতার মতো ভয়ানক সব রোগের সৃষ্টি করে। ২০১৯ সালের বিশ্বব্যাংক কর্তৃক একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিবছর যত মানুষের মৃতু্য হয় তার ২৮ ভাগেরই কারণ পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতা। অন্যদিকে সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃতু্যর হার গড় মাত্র ১৬ শতাংশ, এতেই বোঝা যায় আমরা পরিবেশগতভাবে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি। পৃথিবীর কোনো দেশই পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ড দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি। উন্নয়ন ও পরিবেশ কখনোই সাংঘর্ষিক নয়, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। আমাদেরও উচিত পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকা এবং আমাদের ফুসফুসখ্যাত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতি সাধন করে কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করা। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা এবং কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্রের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য সবুজ বিদু্যতের কার্যক্রম হাতে নেওয়া। নাবায়নযোগ্য সবুজ শক্তি নির্ভরযোগ্য বিদু্যৎ সরবরাহ, জ্বালানি বৈচিত্র্যের মাধ্যমে বিদু্যৎ ও জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণেও সহায়তা করে। এক্ষেত্রে সরকারকে যত দ্রম্নত সম্ভব নবায়নযোগ্য বিদু্যৎ উৎপাদনে করা অঙ্গীকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে।