বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহাদুর্যোগের নাম বায়ুদূষণ

সাধন সরকার সদস্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
  ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

দূষণের মধ্যেই চলছে জীবনযাত্রা। অন্যান্য দুর্যোগের নির্দিষ্ট মৌসুম থাকলেও বায়ুদূষণের কোনো মৌসুম নেই। সারা বছরই চলে দূষণের রাজত্ব! দূষণ নীরব ঘাতক। নীরবেই শরীরের মধ্যে বাসা বেঁধে নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগ সৃষ্টি করে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে এলোমেলো করে দেয় বায়ুদূষণ। অন্যান্য বিষয় যতটা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয় বায়ুদূষণ নিয়ে ততটা আলোচনা করা হয় না। আর যেটুকুও বা আলোচনা করা হয় তার দশভাগের একভাগও সে অনুযায়ী কাজ করা হয় না! কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূষণ ভয়াবহ এক দুর্যোগ হয়ে উঠেছে। সময় এসেছে দূষণ নিয়ে গবেষণা করার, দূষণ নিয়ে ভাবার, দূষণ নিয়ে চিন্তা করার, দূষণ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনার। দূষণকে হেলাফেলা করার কোনো কারণ নেই। কারণ শহুরে শিশুদের জীবনে দূষণের প্রভাব মারাত্মক। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দূষণে জর্জরিত হতে পারে না। এভাবে দূষণ চলতে থাকলে বিভিন্ন ধরনের দূষণের শিকার হয়ে একটা সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে পড়বে! পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষের মৃতু্য হয় তার এক-চতুর্থাংশ মৃতু্য হয় দূষণে। বিভিন্ন প্রকার দূষণের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণে ২০২০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বিশ্বের বায়ুর মানের ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা আইকিউএয়ার। মূলত পিএম ২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার) বস্তুকণার ২.৫ মানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশ ও শহরের তালিকা প্রকাশ করেছে আইকিউএয়ার। গত বছর বাংলাদেশের বায়ুতে পিএম ২.৫ -এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে সাতগুণ বেশি। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ফলে লকডাউনের মধ্যে ২০২০ সালে বায়ুদূষণ কিছুটা কম হয়েছে- এটা সত্য। তবে বায়ুদূষণ থেমে নেই। আবারও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বায়ুদূষণ।

সম্প্রতি ঢাকা শহরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা বলছে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ঢাকার বায়ুদূষণ ১০ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকার বাতাস সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণের চেয়ে দূষিত। একথা ঠিক যে, গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা রয়েছে প্রথম সারিতে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণা মতে, দেশে বায়ুদূষণে বছরে প্রাণ যায় সোয়া লাখের বেশি মানুষের। ঢাকা শহরসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা এটাকে 'দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া' হিসেবে বলতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন ধরনের গ্যাস ও পদার্থ বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, গাড়ির কালো ধোঁয়া, আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়া, ময়লা পোড়ানো, অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাটের ধুলাবালি, অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি বায়ুদূষণের বড় উৎস। বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজু্যয়ালের পর্যবেক্ষণ তথ্য মতে, ঢাকা প্রায় প্রতিদিনই শীর্ষ বায়ুদূষণকারী শহরগুলোর প্রথম তিনটি শহরের তালিকার মধ্যে অবস্থান করছে। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে! বিশ্বব্যাংকের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রায় ৫৮ শতাংশ উৎস ইটভাটা। আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুরা যদি শিশু বয়স থেকেই দূষণের শিকার হয় তাহলে পুরো জীবনেই তাকে এর ফল ভোগ করতে হবে! প্রতিবছর বহু শিশু বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষণের কারণে শিশুর মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি হচ্ছে। এসব কারণে গর্ভাবস্থায় শিশু মৃতু্যর হার বাড়ছে! বায়ুদূষণ মোকাবিলায় এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনি ইশতেহারে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আবার বায়ুদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। বিশ্ব বায়ু পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী যেসব দেশের বায়ুর মান খারাপ, সেসব দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রম্নত হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর রাস্তাসহ নির্মাণাধীন জায়গা ঘিরে দেওয়াসহ ধুলোমাখা স্থানে দুবেলা পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দূষণকারী কর্তৃপক্ষ যত শক্তিশালী হোক না কেন কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষকেও পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে তৎপর হতে হবে। সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় ও সতর্কতা থাকলে দূষণ রোধে সুফল আসবে বলে মনে করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে