শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ংকর

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এখন করোনায় মৃতু্য শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্যানের চাপ বাড়ছে। চারদিকে কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। স্বজন হারানোর শোকে বাতাস ভারী হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আমরা চাই না। দেশ থেকে করোনার প্রকোপ ও মৃতু্য কমে আসুক, দেশের মানুষ নিরাপদে স্বস্তিতে থাকুক এ প্রত্যাশাই করছি।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২১ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

সারাবিশ্ব করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত। দিন যতই যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃতের সংখ্যাও। এ নিয়ে সারা বিশ্ব টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। যে দেশ যতই আশার বাণী শোনাক, এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। করোনার টিকাও নিশ্চিত করতে পারছে না এর প্রতিরোধ। সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত ১৪ কোটি ২১ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৩০ লাখ ৩১ হাজার মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে একদিনে ২ লাখ ৭৩ হাজার আক্রান্ত হয়েছে, একদিনে মারা গেছে ১ হাজার ৬১৯ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। আর বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত ৭ লাখ ২৭ হাজার ৭৮০ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছে ১০ হাজার ৫০০ জনের বেশি। গত তিন দিনে ১০০-র বেশি মানুষ মারা গেছে, সোমবার মারা গেছে ১১২ জন, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তবে গতকাল মঙ্গলবার মৃতু্যর সংখ্যা কমে ৯১ জনে এসেছে। এই সংখ্যা ধীরে ধীরে কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

উলেস্নখ্য, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃতু্য হয়। এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকে। করোনাভাইরাসের তীব্রতা এতই বেড়েছে, উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বল্পতম সময়ের মধ্যে রোগীদের মৃতু্য হচ্ছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পাঁচ দিনের মধ্যে ৫২ শতাংশ করোনা রোগীর মৃতু্য হচ্ছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ রোগী উপসর্গ শুরু পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভর্তি হয়েছিল। ১২ শতাংশ ভর্তি হয় উপসর্গ শুরু ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে। এমন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন. এবারের ভাইরাস কয়েকগুণ শক্তিশালী। যার কারণে দ্রম্নত ফুসফুসে সংক্রমণ শুরু হয়ে রোগীর মৃতু্য ঘটায়। যার কারণে প্রতি ঘন্টায় ৫ জন রোগী মারা যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর বার্তা।

মাঝে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে গিয়েছিল। তখন দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ জন আক্রান্ত হতো। মৃতু্য নেমে এসেছিল ১০-এর নিচে। তখন সবার মধ্যে ঢিলেঢালাভাব লক্ষ্য করা গেছে। তখনো বাংলাদেশ ছাড়া সারাবিশ্বে টালমাটাল অবস্থা, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থাও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে ছিল। এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে আমরা উদাসীন হয়ে পড়লাম। যার চরম খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে। এই অবস্থা আমাদের জন্য খুবই আতংকের। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস, গণপরিবহণ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ১২ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে অবশ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। দেশব্যাপী চলছে কঠোর লকডাউন। এবার আবার ৭ দিন বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, আগের নির্দেশনা বহাল রেখে।

এটা সত্য, করোনা মহামারির কারণে আমরা প্রতিদিনই মূল্যবান প্রাণ হারাচ্ছি। মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দেশের সবাই আজ আতংকগ্রস্ত। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন সফল করতে নিম্নআয়ের মানুষকে বাড়িতে একমাসের রেশন পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, করোনা মোকাবিলায় রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এজন্য যে অর্থ ব্যয় তা হবে, রাষ্ট্রের জন্য বড় কিছু নয়। দিন আনে দিন খায়, তাদের খাবারের ব্যবস্থা না করে লকডাউন বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা লেগেছে অর্থনীতির সব সেক্টরে। বাদ যায়নি শিল্প কারখানাও। গত বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৯৮২টি কারখানার মধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে মোট ৬৩০টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও এসব কারখানার মধ্যে বড় কারখানার সংখ্যা হাতে গোনা। করোনাকালে এই তথ্য নিঃসন্দেগে উদ্বেগজনক। এর ফলে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেল। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

\হউলেস্নখ্য, করোনাভাইরাসের থাবায় ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে স্বাস্থ্যগত ও লকডাউনের কারণে যে অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে, তা মারাত্মক। এর ফলে দেশের দেড় কোটি মানুষ একেবারে দরিদ্র হয়ে যাবে। লকডাউন বাড়ানোর কারণে দেশের গরিব মানুষ সবচেয়ে বিপদে পড়বে। তাদের কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সে ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। জীবন আগে এটা যেমন সত্য, আবার জীবিকা হারিয়ে মানুষ যদি অনাহারে মারা যায়, সেটাও অত্যন্ত দুঃখজনক। সুতরাং সরকারকে বাস্তবতার নিরিখে পরিকল্পিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর্থিক সহযোগিতা বা প্রণোদনার আওতা কীভাবে বাড়ানো যায় সেটাও সরকারকে ভাবতে হবে। করোনাকালে কেউ ক্ষুধায় কষ্ট পাক কিংবা কেউ না খেয়ে মারা যাক, এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। তা হলে সরকারের সব ইতিবাচক অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

দেশের সচেতন মানুষের দাবি, লকডাউন কমপক্ষে ২১ দিন করা হোক। কারণ করোনাভাইরাসের জীবাণু মানুষের শরীরে জীবিত থাকে কমপক্ষে ১৪ দিন। সে বিবেচনায় কমপক্ষে ২১ দিন লকডাউন থাকলে এবং দেশের মানুষ সরকারের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চললে করোনার প্রকোপ কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশের গরিব মানুষের কথা সরকারকে ভাবতে হবে। তাদের জন্য দ্রম্নত বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও সরকার এ ব্যাপারে তৎপর ও মনোযোগী। করোনাকালে নগদ সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের ৩৬ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা ও সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেবে সরকার। এজন্য সরকারের তহবিল থেকে ৯৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সরকারের এ উদ্যোগ ইতিবাচক।

আশার কথা, বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিন-রাত জনগণের মধ্যে সচেতনতা, করণীয় এবং প্রতিরোধের উপায়বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিয়ে মানুষের মধ্যে সাহস, শক্তি জোগাচ্ছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের আলাদা করে আইসোলেশন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংক্রমণের রাশ টানতে আরও বেশি নমুনা পরীক্ষার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রোগী শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। তবে কয়েকদিনের চিত্র ভিন্ন। করোনা রোগী শনাক্ত কম হচ্ছে, অথচ মৃতু্য বাড়ছে।

কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী সার্স-সিওভি-২ ভাইরাস যে মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় সে বিষয়ে 'সামঞ্জস্যপূর্ণ' ও 'দৃঢ় প্রমাণ' পাওয়ার দাবি করে একদল গবেষক বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে রাখা মহামারি মোকাবিলায় দেশগুলোর পদক্ষেপে রদবদল আনা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগেও বিভিন্ন গবেষণায় করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। মানুষের হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সামনে থাকা মানুষের কাছে সরাসরি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার মানুষের হাঁচি-কাশি থেকে বের হওয়া ড্রপলেট বাতাসে ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে যায়। ছোট্ট এই ড্রপলেটকে বলে অ্যারোসল। এই অ্যারোসল মানুষের পায়ে পায়ে বা বাতাসে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। পরে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এই গবেষণা কতখানি সত্য তা এখনো প্রমাণসাপেক্ষ নয়। তবে ঠান্ডাজনিত রোগ বা ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা, ভ্যাকসিন, ওষুধ এবং করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে বিশ্বব্যাপী।

অবশ্য, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দাবি করছেন, কেবল নমুনা পরীক্ষা নয়, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে 'সব ধরনের প্রক্রিয়াই' অনুসরণ করা হচ্ছে। সংক্রমণ কমাতে সরকারের পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব 'দ্রম্নতই পাওয়া যাবে' বলেও আশা করছেন তিনি। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের জনগণ মাস্ক পরার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তারা তা মানছে না। অথচ সারা বিশ্বে মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের চেয়েও সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মাস্ক ব্যবহার করা। কারণ করোনাভাইরাস মূলত বাতাসে ড্রপলেটস বা মুখ থেকে নিঃসৃত মিহি জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। আর মাস্ক ব্যবহার করলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় বলে এক গবেষণায় বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে, দেশের কঠিন সময় চলছে। নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনলে অন্যের কিছুই করার থাকে না। করোনা মোকাবিলা করা প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সম্ভব নয়। দেশবাসীকেও সাবধানে থাকতে হবে, মেনে চলতে হবে সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি ও নানা নির্দেশনা। তবে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক দিক হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা দেশের জনগণ মানছে না। তারা তাদের ইচ্ছামতো চলাফেরা করছে। লকডাউনেও এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ছে। ফলে বিপদ বাড়ছে। সরকারকে এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা উচিত। যারা মাস্ক না পরে বাইরে বের হবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালত দেশব্যাপী কাজ করছে। যারা নিয়ম মানছেন না তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। তারপরেও মানুষ উদাসীন। অনেকেই হাস্যকর কথা বলে, করোনা বলে কিছু নেই।

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এখন করোনায় মৃতু্য শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্যানের চাপ বাড়ছে। চারদিকে কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। স্বজন হারানোর শোকে বাতাস ভারী হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আমরা চাই না। দেশ থেকে করোনার প্রকোপ ও মৃতু্য কমে আসুক, দেশের মানুষ নিরাপদে স্বস্তিতে থাকুক এ প্রত্যাশাই করছি।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে