শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা চিকিৎসা

বাড়িতে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল চিকিৎসাসেবা দিলে জনগণের হয়রানি কমবে, তাদের শয্যার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না, হাসপাতালের সেবার জন্য আয়া রাখতে হবে না, নার্স, সুইপারদের ডাকাডাকি করে মনঃক্ষুণ্ন হতে হবে না।
জাফরুলস্নাহ চৌধুরী
  ২২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

মূল সমস্যা

সারা পৃথিবী কোভিড-১৯ রোগে পর্যুদস্ত। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে চিকিৎসকদের জট ও তাদের দালালের প্রতারণার নেট বিস্তৃত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি একটি দুর্ভাগ্যজনক সত্য এবং নিবেদিত নার্সের সেবা স্বপ্নের ছায়ায় পরিণত হওয়ায় তাদের দায়িত্ব পালন করছে অতিরিক্ত বক্‌শিশের বিনিময়ে আয়া ও সুইপাররা। বড় হাসপাতালে হুইল চেয়ার ও ট্রলির জন্যও ঘুষ দেওয়ার ঘটনা সর্বজনবিদিত। টেকনিশিয়ানদের প্রয়োজনীয়তা চিকিৎসা প্রশাসকদের চিন্তার অন্তর্ভুক্ত নয়। দেশে প্রয়োজন নিদেন পক্ষে তিন লাখ চিকিৎসক, আছে এক লাখের অনধিক। প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজসমূহে ২০,০০০ করে ছাত্রভর্তি করালেও কাম্য সংখ্যায় পৌঁছতে ১২-১৫ বছর লাগবে।

ঢাকায় হাসপাতালে শয্যার স্বল্পতা, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (ওঈট) দুষ্প্রাপ্যতা এবং ব্যবহৃত ওষুধের অত্যাধিক মূল্য ও রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়ার অধিক চার্জ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর ওপর অকল্পনীয় বিবিধ, শুল্ক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে জনগণের সামর্থ্যের বাইরে নিয়ে গেছে। উলেস্নখ্য যে, বাংলাদেশে রোগীকে চিকিৎসার প্রায় ৭২% খরচ নিজেকে বহন করতে হয় (ঙঁঃ ড়ভ চড়পশবঃ ঊীঢ়বহংব-ঙঙচ)। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে রোগীকে এতো অধিক পরিমাণ চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে হয় না। জনগণের অজ্ঞতার কারণে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে আইসিউ (ওঈট) প্রীতি ও আকর্ষণ বেড়েছে, দালালদের আয় বেড়েছে এবং রোগগ্রস্ত পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

তদোপরি অধিকাংশ মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর ওপর কাস্টমস ডিউটি (ঈঁংঃড়সং উঁঃু), রেগুলেটরি ডিউটি (জবমঁষধঃড়ৎু উঁঃু), সাপিস্নমেন্টারি ডিউটি (ঝঁঢ়ঢ়ষবসবহঃধৎু উঁঃু), ভ্যাট (ঠঅঞ), অগ্রিম আয়কর (অফাধহপব ওহপড়সব ঞধী), অগ্রিম কর (অফাধহপব ঞধী) টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স (ঞড়ঃধষ ঞধী ওহপরফবহপব), মূল্য সংযোজন কর (ঠঅঞ) প্রভৃতি একত্রিভূত করে প্রায় ২০% থেকে ৬০% বিবিধ শুল্ক ট্যাক্স বাবদ আদায় করা হয়।

উলেস্নখ্য যে, বড়লোকের প্রাইভেট হাসপাতাল (যথা এভার কেয়ার, ইউনাইটেড, আয়েশা মেমোরিয়াল, ল্যাবএইড, স্কয়ার, আলী আসগর প্রভৃতি) সমূহকে তথাকথিত রেফারেল হাসপাতাল তকমা দিয়ে ব্যবহৃত মেডিকেল যন্ত্রপাতির ওপর বিবিধ শুল্ক রেহাত দেওয়া আছে। তেলে মাথায় তেল ঢালা।

সামরিক বাহিনীর যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সামগ্রীকে উলিস্নখিত শুল্কসমূহ থেকে রেহাত দেয়া আছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব আয়কর বোর্ড (ঘইজ) কর্তৃক ভোগ্যপণ্য থেকে অগ্রিম, আয়কর প্রত্যাহার করা হয়েছে।

অত্যাধিক শুল্কের কতক উদাহরণ

আইভি ফ্লুয়িড ব্যাগ ছাড়া ইনফিউশন সেটে (ওহভঁংরড়হ ঝবঃ) মোট শুল্ক ৬০.৭৩%, মেমব্রেন ফিল্টারে ৬০.৭৩%, আইভি কেনুলায় ৩৮.৮৩%, স্কাল্প (ঝপধষঢ়) ভেইন সেটে ৩৮.৮৩%, গস্নাভসে ২৮.৪৭%, কার্ডিয়াক মনিটরে ৩০%, বস্নাড ট্রান্সফিউশন সেটে ৩৮.৮৩%, ক্যাথেটার সাকশনে ৩৮.৮৩%, ডিফিব্রিলেটরে ২৬.২০%, ডিস্টিলড ওয়াটার পস্নান্টে ২৭.৮৮%, এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট পস্নান্টে ২৬.২০%, ইসিজি (ঊঈএ), ইকোকার্ডিওগ্রাম (ঊপযড়পধৎফরড়মৎধস), ইএসআর (ঊঝজ) মেসিন, পস্নাজমা এক্সট্রুডার, রিয়েল টাইম পিসিআর (জবধষ ঞরসব চঈজ), স্টেরিলাইজারে ২৭.৮৮%, সার্জিকেল এডহেসিভ টেপে ৩৮.৪৭%, প্রস্রাবের ব্যাগে এবং প্রিফিল্ড ও অন্যান্য সিরিঞ্জে ৩৮.৮৩%, পালস অক্সিমিটারে (চঁষংব ঙীরসবঃবৎ) ১৫.২৫%, ভেন্টিলেটরের ওপর মোট শুল্ক ১১.৬৭%। পূর্ণ তালিকা অনেক বড় হবে। (সংযুক্তি-১: সরকার কর্তৃক নির্ধারিত করের বিবরণ)

জীবন রক্ষাকারী প্রকৃতি প্রদত্ত অক্সিজেনের ওপর ১৭.৯৪% মূসক (ঠঅঞ) প্রযোজ্য হয়। তদোপরি মাঝারি ধরনের ১.৪ কিউবেক মিটার অক্সিজেন সিলিন্ডারের মূল্য ২৬,৫২২ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২০০০.০০ (দুই হাজার) টাকা বিবিধ ট্যাক্স।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জার্মান অক্সিজেন সরবরাহকারী বহুজাতিক কোম্পানি লিনডে (খরহফব ইধহমষধফবংয) অন্য কোম্পানি থেকে অপেক্ষাকৃত সুলভে অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি করলে বহুজাতিক কোম্পানি লিনডে তাতে অক্সিজেন ভরে দিতে অস্বীকার করেন। অথচ এই মুহূর্তে ১০০০ (এক হাজার), ১.৪ কিউবিক মাধ্যম মাপের অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের সামর্থ্য লিনডের নেই।

জীবন রক্ষাকারী অতীব প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ল্যাবরোটরি রিএজেন্টসের ওপর ৭ (সাত) প্রকার বিবিধ শুল্ক ও পদ্ধতির কারণে ১১.৬৭%, ১৭%, ২৫%, ২৬.৬৭%, ৩০%, ৩২.৭৫%, ৩৮.৮৩% ও ৬০.৭৩% প্রভৃতি ৮ (আট) পদ্ধতির শুল্কায়ন হয়। হেপাটাইসিস 'সি'-এর ওষুধে ১১.৬৭%, বহুমূত্রের ওষুধ মেটফরমিনে ৩৮.৮৩%, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ প্রাজসিনে ৩২.৭৫%, ক্যান্সারের ওষুধ ট্যামোক্সিফনে ৩২.৭৫% এন্টিবায়োটিক ভ্যানকোমাইসিনে ১৭%, এন্টিবায়োটিক অ্যামিকাসিন ও জেন্টামাইসিনে ২৬.৬৭%। ৮ রকম হারের শুল্কায়নে দুর্নীতি ও হয়রানি বাড়ে। (সংযুক্তি-২: সরকার কর্তৃক নির্ধারিত করের বিবরণ)

১০টি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা দলের প্রতি দুই সপ্তাহে

১০০০ (এক হাজার) করোনা রোগীর চিকিৎসা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৫ জন চিকিৎসক, ২৫ অনধিক মেডিকেল ছাত্র এবং মেডিকেলসেবা সম্পর্কে অজ্ঞ কয়েক শত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ২-৪ সপ্তাহ ইনটেনসিভ মেডিকেল/ নার্সিং প্রশিক্ষণ দিয়ে ৪৮০ শয্যার বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালিত হতো সেখানে অসংখ্য আহত, গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী চিকিৎসা পেয়েছেন। এই হাসপাতালের নিবেদিত প্রচেষ্টা ও সফলতা সবাইকে চমৎকৃত করেছিল।

ঢাকা শহরে সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারা রোগীর অবনতি হয় এবং পরবর্তী সময়ে ওঈট-এর ওপর চাপ বাড়ে। ওঈটতে মৃতু্যর হার উন্নত দেশসমূহেও প্রায় ৪০% এবং চিকিৎসাও ব্যয়বহুল।

১০ সদস্য বিশিষ্ট চিকিৎসক, নার্স- প্যারামেডিক, ফিজিওথেরাপিস্ট, প্যাথলজি টেকনিশিয়ান ও স্বেচ্ছাসেবক সমন্বিত দল করোনা রোগীর বাড়িতে যেয়ে রোগীকে পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করবেন, পরামর্শ দেবেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন। রোগীর প্রাথমিক সেবার জন্য পরিবারের একজনকে প্রশিক্ষণ দেবেন যিনি ভ্রাম্যমাণ দলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন।

ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি সেবামূলক সাশ্রয়ী পদ্ধতি

বাড়িতে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল চিকিৎসাসেবা দিলে জনগণের হয়রানি কমবে, তাদের শয্যার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না, হাসপাতালের সেবার জন্য আয়া রাখতে হবে না, নার্স, সুইপারদের ডাকাডাকি করে মনঃক্ষুণ্ন হতে হবে না।

নিজ বাড়িতে যে কোনো আত্মীয়কে (স্বামী-স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, বাবা, মা, চাচি, দাদি, নাতি প্রভৃতি) কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ দিলে রোগীকে যত্নসহকারে সেবা দিতে পারবেন। রক্তচাপ ও তাপমাত্রা দেখতে পারবেন, নিয়ম মাফিক ওষুধ সেবন করাবেন, রোগীর সমস্যা চিকিৎসকদের ফোন করে জানাবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেবেন, ঘরে বসে বিভিন্ন রিপোর্ট পাবেন। পরিবার সময়মতো রোগীকে পছন্দের খাবার দিতে পারবেন। বাড়িতে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে দ্রত হাসপাতালে স্থানান্তর করা যাবে। পরিবারের যাতায়াতের ভাড়া ও সময় সাশ্রয় হবে। চিকিৎসক বাড়িতে যেয়ে প্রতিদিন রোগীকে দেখে পরামর্শ দেবেন। এ জন্য চিকিৎসক দলকে কোনো ফি দিতে হবে না। সরকারের আর্থিক সাশ্রয় হবে এবং খাদ্য সরবরাহে দুর্নীতি কমবে। রোগী নিয়মিত সব ওষুধ পাবেন। নিজ নিজ বাড়িতে দ্রম্নত চিকিৎসা শুরু হওয়ার ফলে মাত্র ৫-১০% রোগীর ওঈটতে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে এবং অধিকাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অর্থ ও সময় ব্যয় করে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হয়রানির মোকাবিলা করতে হবে না।

\হ

জাফরুলস্নাহ চৌধুরী :গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে