করোনাকালে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়ন

যদি বাল্যবিয়ের ঘটনা না থামানো যায় তাহলে নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ একটি বড়সংখ্যক নারীকে আমরা কিছু করার সুযোগই দিতে পারব না। ফলে সবার আগে আমাদের সবার বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত। পরিবারের লোক এবং সমাজের সবারই এই দায়িত্ব রয়েছে।

প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

অলোক আচার্য
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নারী উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাল্যবিয়ে। একটি মেয়েশিশু লেখাপড়া শুরু করার পরেও মাধ্যমিক পাস করতে না করতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। ফলে সেই মেয়েটির চোখে যে স্বপ্ন ছিল তা স্বপ্নেই থেকে যায়। আবার প্রাথমিকেও বিয়ে হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেখা যায় পিইসি, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় যেসব মেয়ে পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে তাদের অনেকেই বিয়েজনিত কারণে। অনেকটা গোপনেই এই বিয়ের কাজটা সম্পন্ন হয়। মাঝে মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু কত দিনে মন থেকে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিভাবক একমত হবেন তা আমাদের অজানা। অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং বহুকাল ধরে কন্যাশিশু নিয়ে যে ধারণা রয়েছে তার পরিবর্তন আজও হয়নি। করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় এই প্রবণতা আরও বেড়েছে এবং অনেকেই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করছে। দেশ হিসেবে আজ আমাদের বহু অর্জন। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে আমরা আজ রোল মডেল। এতসব অর্জনের মাঝেও কিছু খবর আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। যখন নারীরা সমানতালে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শামিল হচ্ছে তখন বাল্যবিয়ে আমাদের অভিশাপ হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। কোনোভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আর সেই কিশোরীর মতো পরিণতি না হলেও বাল্যবিয়ের ফলে এক কিশোরীর স্বপ্নের যে মৃতু্য ঘটে তাও তো মৃতু্যই। আধুনিক সভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারীর অবদান অনস্বীকার্য। আর এই অগ্রযাত্রায় এখন প্রধান বাধা হলো বাধ্যবিয়ের মতো বাধা। যার জন্য সেই হতভাগ্য কিশোরীর পরিবার দায়ী থাকে। মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় বাল্যবিয়ের অপরাধে শাস্তিও হচ্ছে। কিন্তু সামাজিক সচেতনতা গড়ে না ওঠার দরুন তা রোধ করা যাচ্ছে না। আজও সেই একই মানসিকতা রয়েছে বহু পরিবারে। মেয়েকে যত দ্রম্নত বিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল! এই ধরনের আদি মনমানসিকতা থেকে আমরা আজও অনেকেই বের হতে পারিনি। সেই চেষ্টাও করছি না। আবার এই করোনাভাইরাস মাহামারির সময় বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপের তথ্যে জানা যায়, দেশে করোনার প্রকোপে বাল্যবিয়ের হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের জুন মাসে ৪৬২টি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। একই সময়ে ঠেকানো গেছে ২০৭টি বাল্যবিয়ে। ওই বছরের মে মাসে বাল্যবিয়ে হয়েছিল ১৭০টি। করোনা যেহেতু সারা বিশ্বেই তান্ডব ছড়াচ্ছে ফলে এটা কেবল আমাদের দেশের চিত্র নয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারি আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ২৫ লাখ কিশোরীকে বাল্যবিয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, করোনা মহামারির কারণে আগামী এক দশকে আরও ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হবে। করোনার কারণে মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত পরিবারগুলোর আয় কমেছে। তাদের জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দ্রম্নত দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে বাল্যবিয়ের মতো ঘটনা বেড়ে চলেছে। মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এবং দরিদ্র পরিবারগুলো আরও দরিদ্র হয়ে পড়ায় বাল্যবিয়ের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। কারণ কতদিনে করোনা মহামারি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, করোনার আগের মতো পরিবেশ ফিরে আসবে তা আমাদের অজানা। বাল্যবিয়েও আসলে এক ধরনের ক্যান্সার। যা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাকালীন সময়ে এই রোগ আরও তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এসবের মধ্যে কিছু সাহসী কিশোরী নিজেদের বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পাশাপাশি সমাজের আরও অনেক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। কিন্তু ক'জন কিশোরীর এত সাহস হতে পারে? তাও আবার এই সমাজে। প্রতিরোধ গড়া সত্যিই খুব কঠিন একটা বিষয়। আমরা একজন শিশুর কাছ থেকে তার শৈশব, একজন কিশোরীর কাছ থেকে তার কৈশর কেড়ে নিচ্ছি। তাকে মুক্ত পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ দিচ্ছি না। তার আগেই তার ওপর সংসার নামের এক গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে তাকে ভারে নু্যব্জ করে দিচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীনকালে 'কন্যাদায়' বলে যে শব্দ প্রচলিত ছিল এখনো অনেক অভিভাবক সেই কন্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে না চিন্তা করে দায় হিসেবেই গ্রহণ করছে। ফলে সেই কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে আইনের তোয়াক্কা না করে, নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে নিজেকে দায় থেকে মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তখনই সর্বনাশ ঘটে। একজন মানুষের স্বপ্ন নষ্ট করার অধিকার আমাদের কারোরই নেই। সে যদি মা-বাবা হয় তাও নয়। ছেলে সন্তানের মতোই কন্যা সন্তানেরও স্বপ্ন থাকে কিছু করার বা হওয়ার। দেশের জন্য তারও অবদান রাখার সুযোগ পাওয়া উচিত এবং যখন সবার ক্ষেত্রে এই সুযোগ সৃষ্টি হবে তখনই আমরা সফল বলে ধরতে পারি। যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার কমছে কিন্তু আমাদের লক্ষ্য বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গৃহীত হওয়ার সময় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশ বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ হয়। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর। নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশির ভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলে সন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘর কন্যার কাজে লেগে পড়া যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আবার বিয়ের পর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও প্রায়ই দেখা যায়। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা কমছে না। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। এই যে একটা শিশুর শৈশব নষ্ট করে তার ওপর সংসার চাপিয়ে দেওয়া হয়- যা তার জীবনকে ঝুঁকির মধ্য ফেলছে তা একটি বড় অপরাধ। অনেক সময় সবার অগোচরেই বিয়ের কাজটি সমাধা হয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। ফলে এর লাগাম টেনে ধরতেই হবে। নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সীমাবদ্ধ। নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে আমাদের আরও সুদৃঢ় হতে হবে। অথচ কেবল বাল্যবিয়ে নয় যৌতুক, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ,পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। পরিবার এবং পরিবারের বাইরে নারীর নিরাপত্তা যেন কোথাও নেই। যৌতুকের আগুনে আজও আমাদের সমাজে বহু নারীর জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শহর বা গ্রাম, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সব ধরনের পরিবারেই যৌতুক নামের একটি কাঁটা রয়েছে। মূলত বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক নামক এক ভয়ংকর প্রাচীর থেকে জীবনের আদিমতা থেকে আজও আমরা বের হতে পারিনি। কারণ কেবল বাংলাদেশ নয়- ভারত,পাকিস্তানসহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এই বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক প্রথা। এসবের মধ্যে বাল্যবিয়ে এমন একটি ঘটনা যেখানে তার অনিচ্ছায় তার ভবিষ্যৎকে নষ্ট করা হয়। \হযদি বাল্যবিয়ের ঘটনা না থামানো যায় তাহলে নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ একটি বড়সংখ্যক নারীকে আমরা কিছু করার সুযোগই দিতে পারব না। ফলে সবার আগে আমাদের সবার বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত। পরিবারের লোক এবং সমাজের সবারই এই দায়িত্ব রয়েছে। অলোক আচার্য : শিক্ষক ও কলাম লেখক