স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেট কেমন হওয়া উচিত

স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান সংকট এ খাতকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানোর একটি সুযোগ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমরা স্বাস্থ্য খাতকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের কাজটি এ বাজেটেই শুরু করতে পারি। এ খাতের উন্নয়নে বাজেটের প্রাধিকারকে দুই ভাগে ভাগ করতে চাই। এক, মহামারি মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা এবং দুই, জনস্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, যেমন- স্বাস্থ্য খাতের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও পরিবর্ধনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এজন্য একটি স্বল্প-তাৎক্ষণিক, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন, যার ভিত্তিতে বাজেটারি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।

প্রকাশ | ১১ মে ২০২১, ০০:০০

ডা. সমীর কুমার সাহা
মানুষ যুদ্ধ করার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। কিন্তু মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য খুব বেশি ভাবেনি এবং স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে তেমন কোনো পরিকল্পনাও নেয়নি। এবারের করোনা মহামারিতে বিশ্ব বুঝতে পেরেছে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ কতটা জরুরি বিষয়। করোনা দেখিয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্যসুরক্ষা ছাড়া এ পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকা কঠিন। আমাদের দেশও স্বাস্থ্য খাতে পিছিয়ে আছে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধিসহ বিনিয়োগ এবং ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই আগামী বাজেট হওয়া উচিত জীবন ও জীবিকা রক্ষার বাজেট। আসছে বাজেটে এই দুটি খাতই সমান ও সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে বলে আশা করি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ইতোমধ্যে তা বলেছেনও। 'বিল্ডিং অ্যাওয়ারনেস অব ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ বাংলাদেশ অ্যাডভান্স দি এজেন্ডা ফরওয়ার্ড'-২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে বাংলাদেশে জনপ্রতি পাবলিকের পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ। যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। জনপ্রতি ব্যয়ের দিক থেকে ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় ভারত, ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ দিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে নেপাল, ৩৫ দশমিক ৬ নিয়ে সবার নিচে রয়েছে থাইল্যান্ড। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- এ খাতে অপর্যাপ্ত ব্যয়, সরকারি ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণহীনতা, বাজেটে কম বরাদ্দ, বরাদ্দ অনুযায়ী সঠিকভাবে বণ্টন না করা, অতিরিক্ত পকেট মানি, সরকারি ও পকেট মানির বিস্তর ব্যবধান, নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত, স্বাস্থ্য বীমায় অনিহা, দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা কমে যাওয়া ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বল্প অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। অন্যদিকে দেশের শিশুমৃতু্য হ্রাস, পুষ্টির উন্নতি, টিকাদানের হার বৃদ্ধি- স্বাস্থ্য খাতের এসব সাফল্যে বেসরকারি খাতের কোনো ভূমিকা ছিল না। নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি খাতের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা অর্জনে এটি বড় ধরনের বাধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য মতে, স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতি বছর সাড়ে ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। আর বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে সোয়া দুই কোটি মানুষ। সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করতে না পারার কারণে প্রতি বছর ৭০ লাখ লোক চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যেতে হয় বা যেতে হচ্ছে- যাচ্ছে। এই সংখ্যা বা হার কমিয়ে আনতে হলে চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেককে তাদের দায়িত্বের জায়গায় সচেতন হতে হবে। সংযুক্তি ঘটাতে হবে নিত্যনতুন সব প্রযুক্তি। সঙ্গে প্রযুক্তিবিদ বা চিকিৎসা সহায়তাকর্মী। মূলত দুর্বলতা এখানেই। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা অর্জন করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা আরও বাড়াতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সহযোগিতার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করাই যথার্থতা। গবেষণায় প্রমাণিত, স্বাস্থ্যসেবার ৬০ শতাংশ মানুষ পায় অসংগঠিত খাত থেকে। সরকারি খাত থেকে সেবা আসে ১৪ শতাংশ। আর বেসরকারি খাত থেকে মানুষ ২৬ শতাংশ সেবা পায়। বেসরকারি খাতের অবদান ছাড়া কোনো দেশই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা অর্জনে সাফল্যের পথে এগোতে পারেনি। এক্ষেত্রে চীন ও কিউবার মতো গুটি কয়েক দেশ ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তাদের সরকার ব্যবস্থাও ভিন্ন ধাঁচের। কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থা তার যোগ্যতাবলেই পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবত আমেরিকা কিউবাতে কোনো রকম স্বাস্থ্যভিত্তিক পণ্য প্রবেশ ও রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখলেও তা কিউবাকে খুব একটা টলাতে পারেনি। ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার পর 'স্বাস্থ্য খাত'কে জাতীয় উন্নতির এক নম্বর প্রায়োরিটি হিসেবে ঘোষণা দেন। অনেকের মতে, নাগরিকদের সর্বোচ্চ সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণই ফিদেলের এতযুগ ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ। প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা নির্ভর একটি নতুন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয় কিউবায়। এ ব্যবস্থার আওতায় পারিবারিক চিকিৎসকদের জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি এবং প্রতিরোধমূলক শিক্ষাকে চিকিৎসার সঙ্গে সমন্বিত করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বিশেষ পর্যায়ে যেসব এলোপ্যাথিক ওষুধের সংকট, সেসবের বিকল্প অনুসন্ধানের একটা তাগিদ থেকে আয়ুর্বেদিক ওষুধের মতো বিকল্প এবং লোকজ চিকিৎসার প্রতি উৎসাহ আরো জোরদার হয়। কিউবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একদল বিজ্ঞানীর সংকলন করা ঔষধি গাছগাছড়া থেকে তৈরি 'মেডিসিনা ভার্দে' বা 'সবুজ ওষুধ'বিষয়ক একটি নির্দেশনা তৈরি করে। বেশির ভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গাছগাছড়া থেকে তৈরি ওষুধের তালিকা ঝোলানো হয়, গ্যাস্ট্রিক থেকে শুরু করে মাংসপেশির ব্যথা ইত্যাদি সারাতে কোন কোন ওষুধ কাজে লাগে তাও ওই তালিকায় উলেস্নখ করা হয়। বিকল্প চিকিৎসার প্রতি এই যে উৎসাহ, কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থায় তার একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। কারণ এসব বিকল্প বা ট্রেডিশনাল চিকিৎসা কিউবার সব মেডিকেল স্কুলের নিয়মিত পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে আকুপাংচারের মতো ভিনদেশি সংস্কৃতি থেকে গৃহীত চিকিৎসা পদ্ধতিও রয়েছে। অথচ আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদ-ইউনানী চিকিৎসাকে বরাবরই অবহেলার চোখে দেখে মূলধারা থেকে দূরে সরিয়ে রেখা হয়েছে। আর বিলম্ব না করে এবার বাজেটেইে ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থা আয়ুর্বেদ ও ইউনানীর উন্নয়ন, গবেষণায় অধিকতর বাজেট বরাদ্দ দেয়া সমুচিত। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সিংহভাগ শহরে অবস্থিত, অথচ মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ গ্রামে থাকে- এ এক চরম বৈষম্য। স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ না করা গেলে চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের শহরমুখিতা বাড়বে। তাতে শহরের যানজট বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসেবার অবনতি ছাড়া আর কিছু হবে না। সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে জনগণের অংশগ্রহণ, সব বিভাগের সমন্বয়, সুষম স্বাস্থ্য বণ্টন যার প্রয়োজন শহর থেকে গ্রামে, ব্যক্তিগত হতে সামাজিক, প্রতিরোধ হতে প্রতিরোধ পর্যায়, পরিবর্তনের স্বাস্থ্যকে উন্নয়নের ওপর স্থান দেয়া- সেই সঙ্গে উপযুক্ত কৌশল প্রণয়ন, গুণগত বিশ্লেষণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সবার জন্য সর্বত্র নিশ্চিত করতে পৃথিবীর অনেক দেশ- ভার্চুয়াল ব্যবস্থাকে অনেক আগে থেকেই আত্মীকরণ করেছে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান থেকে শুরু করে নানাভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকি মোকাবিলা করছে। এখানে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ছাড়াও সাধারণ জনশক্তিকে বিশ্বমানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের চিকিৎসকরা শুধু হাসপাতালকে কেন্দ্র করে শিক্ষিত হন, তাদের ঝোঁক থাকে রোগের কারিগর হয়ে ওঠার দিকে। স্বাস্থ্যের সামাজিক, মানসিক কিংবা পরিচ্ছন্নতা-রোগতাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ থাকে না। এ দিকটায় বিশেষ নজর দেয়া উচিত। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বৈষম্যহীন জনমুখী রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সংবিধান অনুসারে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। সেই সেবা দিতে আমাদের একটি সময়োপযোগী স্বাস্থ্য মানবসম্পদ নীতি প্রণয়ন আবশ্যক। যে নীতি আদর্শ গ্রহণপূর্বক স্বাস্থ্য কাঠামোর বিবেচনা করে সর্বক্ষেত্রে, সবার জন্য সঠিক পরিমাণে সঠিক গুণগত মানের স্বাস্থ্য ও জনশক্তি গড়ে তুলবে। করোনা মহামারির কারণে আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক বেহাল চিত্র ফুটে উঠেছে। আমরা উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত হাসপাতাল তৈরি করেছি, কিন্তু তাতে স্বাস্থ্যসেবার নূ্যনতম সুবিধাও অনেক ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায়নি। করোনা মহামারি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বেহালকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছে। ঐতিহাসিকভাবে দুর্নীতিতে ভারাক্রান্ত এবং অদক্ষতা ও অবহেলার শিকার জনস্বাস্থ্য আমাদের আজ এক নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে। স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান সংকট এ খাতকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানোর একটি সুযোগ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমরা স্বাস্থ্য খাতকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের কাজটি এ বাজেটেই শুরু করতে পারি। এ খাতের উন্নয়নে বাজেটের প্রাধিকারকে দুই ভাগে ভাগ করতে চাই। এক, মহামারি মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা এবং দুই, জনস্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, যেমন- স্বাস্থ্য খাতের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও পরিবর্ধনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এজন্য একটি স্বল্প-তাৎক্ষণিক, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন, যার ভিত্তিতে বাজেটারি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। ডা. সমীর কুমার সাহা : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।