শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ

নিম্নবিত্তের চাহিদা সবচেয়ে কম। তাদের প্রয়োজন তিনবেলা ডালভাত। করোনাকালে তাও ঠিকমতো জোটাতে পারছে না তারা।
মোহাম্‌মদ শাহাবুদ্দিন
  ১১ মে ২০২১, ০০:০০

করোনা অতিমারি চলছে। এই প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশে দেশে চলছে লকডাউন। বাংলাদেশেও 'কঠোর লকডাউন' দেয়া হয়েছে। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এই তিন রকম মানুষের জীবনের চ্যালেঞ্জ নিজেদের মতো। কিন্তু মৌলিক চাহিদা এক। সবারই দরকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদন। করোনা অতিমারিকালে আর সব বাদ দিয়ে শুধু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে এই তিন শ্রেণির মানুষ।

নিম্নবিত্তের চাহিদা সবচেয়ে কম। তাদের প্রয়োজন তিনবেলা ডালভাত। করোনাকালে তাও ঠিকমতো জোটাতে পারছে না তারা।

স্বাভাবিক সময়েই অতিকষ্টে জোগাড় করতে হয় ভাত-কাপড়। গত এক বছর ধরে তো অস্বাভাবিক সময় চলছে। এ সময় তাদের বিপদসীমা পেরিয়ে অসীমামে ঠেকেছে।

কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, দিনমজুর, রিকশাচালক, ঠ্যালাগাড়িচালক, ভ্যানচালকসহ এ শ্রেণির আরও অনেকের জীবন ত্রাহি ত্রাহি। দিন এনে দিন খাওয়া এই মানুষ নিম্নআয়ের। প্রতিদিন যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকম চাল-ডাল-নুন-তেল কিনতে পারে। সঞ্চয় করার এতটুকু সুযোগ নেই। করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে নিম্নবিত্ত এই শ্রেণির মানুষ আছে চরম বিপাকে।

গত এক বছর ধরে করোনার কারণে লকডাউন, সাধারণ ছুটি লেগেই আছে। কারণে অকারণে কাজকর্ম বন্ধ। একদিন কাজ না করলে যাদের জীবন চলে না তারা এক বছর ধরে বেকার কিংবা ছদ্মবেকার। কীভাবে টিকে আছে তারা? সরকার মাঝেমধ্যে চাল-ডাল-নুন-পেঁয়াজ সহায়তা দেয়। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে হয়। অনেকের কপালে তাও জোটে না। বাধ্য হয়ে একপেট-আধপেট খেয়ে জীবন চালাতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাই রাজধানী ঢাকা শহরে বেড়ে গেছে ভিক্ষুকের পরিমাণ। রাস্তায় বেরুলে নতুন নতুন ভিক্ষুকের সঙ্গে দেখা হয়। প্রায় প্রতিদিনই এক দুজন নতুন ভিক্ষুক চোখে পড়ে।

অনেকে আবার শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। সেখানেও তেমন কোনো কাজ নেই। নিজের ঘরে থাকতে পারে বলে বাসাভাড়ার চাপ নিতে হয় না। বাকি মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ক্ষেতে-খামারে শ্রমিকের কাজ করবে তাও সম্ভব হয় না। গ্রামে যারা আগ থেকে আছে তাদের কাজ দিয়ে নতুনদের ডাকা হয়।

\হবর্তমান সময়ে দেশের অধিকাংশ এলাকায় আধুনিক প্রযুক্তিতে ধানকাটা, পরিববহণ ও মাড়াই করা হয়। শ্রমিক কম প্রয়োজন হয়। পাঁচজন শ্রমিকের কাজ করতে পারে একজন শ্রমিক ও একটা মেশিন। ফলে গ্রামে গিয়েও কোনো কাজ পাচ্ছে না শহর ফেরত শ্রমিকটি। এক করোনা সবার জীবন তছনছ করে দিয়েছে। নিম্নবিত্তের মানুষ টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। বিরামহীন সংগ্রামের পরও টিকে থাকতে পারছে না।

নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। এ শ্রেণিটার বেশিরভাগই ছোটখাটো চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। যারা সরকারি চাকরি করছে কেবল তারাই নিশ্চিন্ত জীবন কাটাতে পারছে। অফিস খোলা থাকুক কিংবা বন্ধ, তারা নিয়মিত বেতনভাতা পাচ্ছে। চাকরিরও নিশ্চয়তা আছে।

সমস্যা বেসরকারি চাকরিজীবীদের। তাদের অফিস বন্ধ থাকলে বেতন পাওয়া নিশ্চিত নেই। করোনা অতিমারিকালে লকডাউন, সাধারণ ছুটি এসব কারণে অফিস বন্ধ থাকার কারণে অনেকের ঠিকমতো বেতন হয়নি। কারও অর্ধেক বেতন হয়েছে। অনেকে আবার চাকরি হারিয়েছে। কাজকর্ম খুব একটা নেই বলে খরচ কমানোর জন্য মালিক কর্তৃপক্ষ, কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাঁটাই করছে।

এই করোনাকালে যারা চাকরি হারিয়েছে তাদের অধিকাংশই নতুন কোনো চাকরিতে যোগদান করতে পারেনি। জীবনে নেমে এসেছে আরেক ধাক্কা। সংসারের খরচ, প্রতি মাসের বাসাভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন, সব মিলে ভয়াবহ অবস্থা। নিম্নমধ্যবিত্ত এই শ্রেণিটাও তাই মহাবিপাকে।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণির ব্যবসায় মন্দা টানা এক বছর ধরে। করোনার কারণে বেশিরভাগ সময় দোকানপাট বন্ধ ছিল। ব্যবসার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে লাভের চেয়ে লোকশানের পরিমাণ বেশি। গত এক বছরের লোকসানের বোঝা টানতেই নাভিশ্বাস ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণিটির। তার মধ্যে আবার 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এই ধাক্কা সামলানো খুব কঠিন হবে।

গত বছরের ধারদেনা পরিশোধ করতেই হিমশিম খাচ্ছে ক্ষুদ্রব্যবসায়ী শ্রেণি। দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানো সত্যিই কঠিন। সরকার প্রণোদনার যে ঘোষণা দিয়েছে তা যদি সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনুপাতিক হারে পায় তাহলে কিছুটা রক্ষা।

সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে সাধারণত মাঝারি ব্যবসায়ী, উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, উচ্চপদের বেসরকারি চাকরিজীবী ও করপোরেট কর্মকর্তাকে বোঝানো হয়। এই শ্রেণিটি সবসময় একটি সামাজিক মর্যাদা নিয়ে চলে।

করোনাকালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশ ভালোই আছে। করোনার ভয় ছাড়া তাদের আর্থিক তেমন কোনো সমস্যা নেই। মাসশেষে নিয়মিত বেতন পাচ্ছে। বাজার-সদায় করে পরিবার-পরিজন নিয়ে আরামে দিন কাটাচ্ছে।

বেসরকারি উচ্চপদের কর্মকর্তাটি আছে দুশ্চিন্তায়। করোনাকালে অনেক অফিসেই ঠিকমতো বেতন হচ্ছে না। উচ্চপদে যারা আছে তাদের বেতন কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও কাটছাঁট করা হয়েছে। এমন নজিরের অভাব নেই।

করোনার অজুহাতে অনেকের চাকরি চলে গেছে। চাকরিহারা এই মানুষটি কী করবে? বাধ্য হয়ে বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসায় চলে যায়। জমানো যে কটা টাকা ছিল তা দিয়ে ক'মাস চলে। তারপর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না।

এই শ্রেণিটি সরকারি-বেসরকারি কোনো অনুদান পায় না। কারও কাছে হাত পাততে পারে না। আত্মীয়স্বজনও তেমন একটা সহযোগিতা করে না। বাধ্য হয়ে নিজের মান-মর্যাদা পদদলিত করে নিচের দিকে নামতে থাকে।

মাঝারি ব্যবসায়ী শ্রেণিটির অবস্থা আরও করুন। করোনাকালে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে গিয়ে দশজন কর্মচারী থেকে ছাঁটাই করতে করতে পাঁচজনে নেমেছে, তাও চালাতে পারছে না ব্যবসা। এক বছরের মহাধাক্কা সামলাতে ধারদেনা তো আছেই।

এবারের করোনা অতিমারি কিছু সামাজিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এই যে তিন শ্রেণির মানুষের আর্থিক চ্যালেঞ্জ তা সামাজিক সংকটের সবচেয়ে উপরে। অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে অন্যকিছু সংকট অটো সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, জীবনের নিশ্চয়তা কম। সরকার কারও জীবন চালানোর দায়িত্ব নেয় না। উন্নত বিশ্বে জাতীয় দুর্যোগকালে নাগরিকদের সব দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে তেমন না।

সেদিন ইউটিউবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বক্তব্য শুনলাম। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, দেশে একমাস লকডাউন থাকবে। সবাই ঘরে থাকবেন। কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। এই একমাসের খাবার, ওষুধপাতি, পথ্যসহ অন্যান্য সামগ্রী বাসায় পৌঁছে যাবে। যারা চাকরি করছেন তাদের বেতনভাতা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। আপনারা ঘরে থাকুন। পরিবারের সঙ্গে নিশ্চিন্ত ও আনন্দময় জীবন কাটান। কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনাদের সব দায়িত্ব সরকারের।

কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কথায় পরিষ্কার বোঝা গেছে যে লকডাউনের একমাস নাগরিকদের সব দায়িত্ব সরকারের।

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষেত্রে উল্টো। যার যার দায়িত্ব তার তার। কে কীভাবে জীবন বাঁচাবে, টিকে থাকবে তা তাকেই চিন্তা করতে হবে। এই যে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এই তিন শ্রেণির মানুষের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার সংগ্রাম তা একান্তই তাদের। আলস্নাহতায়ালা যদি তাদের করোনা অতিমারিকালে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি, সাহস, মনোবল দেন তাহলে রক্ষা।

মোহাম্‌মদ শাহাবুদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে