শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সেকালে ও একালে বাংলাদেশের ঈদ উৎসব

এই শতকের শুরু থেকেই যখন রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। বাংলাদেশের দুটি ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। করোনার সময়ে অবশ্য পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। ঈদ উৎসব হয়তো আগের মতো প্রাণবন্ত হবে না। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  ১২ মে ২০২১, ০০:০০

মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত জাঁকজমক ও ধুমধামের সঙ্গে এই ধর্মীয় দিবস দুটি পালিত হতে দেখা যায়। ঈদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রথম ঈদ পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরির ০১ শাওয়াল মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ মদিনায়। আর মক্কায় প্রথম ঈদ পালিত হয় অষ্টম হিজরি মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর প্রায় ১১ দিন পর। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। বাংলাদেশে প্রথম কোথায় ঈদ পালিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায় সন্দ্বীপ অঞ্চলে প্রথম ঈদের জামায়াত হয়েছিল। ঢাকায় সম্ভবত প্রথম ঈদ উদ্‌যাপিত হয় সুলতানি আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খ্রি.) মোটামুটি দুই শত বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে এখন যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, ১০০ বছর আগেও কি এভাবে হতো? সাধারণ মানুষ কি আজকের মতো অধীর আগ্রহ, উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন ঈদের চাঁদের দিকে? ঈদের ধুমধামের দিকে? ইতিহাস বলে 'না'। তবে সে আমলে কীভাবে বাংলাদেশে ঈদ উৎসব পালিত হতো।

আমাদের সবারই স্মরণ রাখতে হবে বিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞাসা মেলে না। জ্ঞান আহরণের উৎসই জিজ্ঞাসা। রাসূল (সা.) বলেছেন 'জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনেও যাও। সুতরাং এই প্রবন্ধে বর্তমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কারও ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আঘাত দেওয়ার জন্য আমার এ লেখা নয়। প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার জন্য আমার এই অবগাহন। আমি একজন মুসলমান হয়ে নিজেকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে করি।

রমজান মাস মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র মাস এবং কোরআনে একমাত্র এ মাসের কথাই উলেস্নখ করা হয়েছে। এ মাসেই নাজিল হয়েছে কোরআন শরিফ। প্রথম ওহি পেয়েছিলেন মুহম্মদ রাসূল (সা.)। গিয়েছিলেন তিনি মেরাজে। মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার আগে রমজানের সঙ্গে পরিচয় ছিল না মুসলমানদের। এর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল হিজরতের পরেই। রমজান শব্দটি আরবি 'রমজ' ধাতু থেকে আগত। রমজান মানে দাহ, তাপ বা পোড়ানো। চন্দ্রবর্ষই নিয়ন্ত্রিত করে করে মুসলমানদের উৎসব। অনেক আগে প্রাচীন কালে গরমের মৌসুমে এই মাস পড়ত বলে এর নাম হয় রমজান। রমজানের সঙ্গে উপবাসের প্রতি শব্দের ধ্বনিগত কোনো মিল নেই। উপবাসের আরবি নাম হচ্ছে 'স ও ম'। এর অর্থের সঙ্গে উপবাস ব্রতের কোনো মিল নেই। এর আভিধানিক অর্থই হলো আরাম বা বিশ্রামে থাকা। রমজান শেষে ঈদুল ফেতর। ঈদের অর্থ হলো উৎসব এবং আভিধানিক অর্থ হলো বারবার ফিরে আসা। ঈদ শব্দটি মূলত সিরিয়ার। ঈদ শব্দটির আদি অর্থ ও তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম নিরীক্ষণ করে দেখে মনে হয় হয়তো এককালে এ ধরনের এক সামাজিক উৎসবের সঙ্গে পরিচিত ছিল সিরিয়ার দামেস্কের জনগোষ্ঠীর অধিবাসীরা। হয়তো সিরিয়ার দামেস্কের কৃষিজ আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল এই আজকের ঈদ উৎসব এবং তাদের কাছ থেকেই আচার-অনুষ্ঠান জ্ঞাপক শব্দের মতোই আরবরা আমদানি করেছেন বর্তমান এই ঈদ উৎসব ও তার প্রকৃতিকে। ঈদ উৎসব মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস বিশ্লেষণ করলে আমাদের মনে রাখতে হবে এদেশে মুসলমানরা ছিল বহিরাগত। কারণ যেভাবে অতীতে পালিত হতো এই ঈদ উৎসব তাতে লোকায়ত বিশ্বাস আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে হিন্দু রীতিনীতি প্রভাবই ছিল বেশি।

ইসলাম প্রচারের শুরুতে অর্থাৎ আদি বাঙালি মুসলমানরা কীভাবে ঈদ উৎসব পালন করত তা রীতিমতো গবেষণার বস্তু। তবে বলা যেতে পারে আদিতে প্রচার করা আরবের উদ্‌যাপিত ঈদের আদি রূপই হয়তো তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কালের গর্ভে সময়ের বিবর্তনে সে রূপ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কখনো ধর্ম নেতারা মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন তাদের নিজের গড়া নতুন অনুষ্ঠান। কখনো শাসক শ্রেণির নির্দেশে যুক্ত হয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম। কখনো বা লৌকিক ধর্মের প্রভাব এসেছে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে। সে জন্য আবারও বলতে হয় বাংলাদেশে যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে তাতে সেখানে প্রভাব ফেলেছে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস। হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি প্রভাবিত করেছে আপামর এই বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে।

উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ শতবর্ষ আগে ঈদের দিনটি কীভাবে পালন করতেন সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে মানুষের মনেরও পরিবর্তন ঘটেছে। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের ফলে। এখানে পুরনো আমল বলতে আমরা আশি-নব্বই বছরের বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরতে চাই। শতবর্ষ আগে সাহিত্য, সংবাদ সাময়িকী পত্রে ঈদের তেমন কোনো উলেস্নখযোগ্য বিবরণ আমরা পাইনি। এ দেশের হিন্দু, মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখে গেছেন তাদের রচনায় আমরা দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মহরম এমনকি রথযাত্রা, দোলপূর্ণিমা, দীপালি উৎসব এরূপ বিভিন্ন পূজাপার্বণ সম্পর্কে বিস্তর উলেস্নখ দেখতে পাই। শুধু পাওয়া যায় না ঈদুল ফিতর সম্পর্কে। তবে একালে যারা জন্মেছেন তাদের বিবরণীতে কচিৎ ঈদুল ফিতর সম্পর্কে খানিকটা তথ্য পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় ঈদুল ফিতরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসব শতবর্ষ আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে আজিকার মতো অনাবিল হাসি, আনন্দের বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। এ থেকে যদি আমরা বলি ঈদুল ফিতর সেকালে বাংলাদেশে তেমন কোনো বড় উৎসব হিসেবে পালন হয়নি তবে কী তা ভুল বলা হবে? মনে হয় নিশ্চয়ই না। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, বাঙালির ঈদকে দেখি একটা সামাজিক ধর্মীয় বড় উৎসব হিসেবে তা কিন্তু সত্তর-আশি বছরের ঐতিহ্য মাত্র। বর্তমানে গ্রাম-বাংলায় রোজা ও ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে তা কিন্তু সে আমলে নব্বই বছর আগেও অবশ্যই মোটেই এভাবে পালিত হতো না। ব্রিটিশ আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে এ বাংলায় প্রচলিত ছিল এবং ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল তাহলো খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের 'ক্রিসমাস ডে'। ব্রিটিশ আমলে বিদ্যার দিক থেকে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে 'ক্রিসমাসের' পরেই সরকারিভাবে তো বটেই সম্প্র্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এই অঞ্চলে হিন্দুদের 'দুর্গাপূজা' হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জাঁকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। অফিস আদালতে ইংরেজ আমলে সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পূজার জন্য ছিল অনেক বেশি। সে আমলে সরকারি নথিপত্রে ও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্যাদি।

শাসক ইংরেজরা স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ঈদকে গুরুত্ব দেয়নি। এজন্য সরকারি ছুটিও বরাদ্দ ছিল কম। তা ছাড়া মুসলমানদের পক্ষে ঈদকে সে আমলে উৎসবে পরিণত করা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। কারণ গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মুসলমান ছিল বিত্তহীন ও নিরক্ষর।

আবুল মনসুর আহমেদ তার আত্মজীবনীতে আরও লিখেছেন 'ঊনিশ শতকের শেষার্ধ্বে ও সে সময় নামাজ-রোজা চালু ছিল না। তাদের গ্রামাঞ্চলে ছিল না কোনো মসজিদ। তরুণদের তো কথাই নেই। বয়স্করা ও সকলে রোজা রাখতেন না। দিনের বেলা তারা তামাক ও পানি খেতেন। শুধু ভাত খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোজা নষ্ট হতো না। এই বিশ্বাস ছিল তখন তাদের মনে। রোজার মাসে মাঠে যাওয়ার সময় একটা বাঁশের চোঙ্গা রোজাদাররা সঙ্গে রাখতেন। পানি বা তামাক খাওয়ার শখ হলে এই চোঙ্গার খোলা মুখে মুখ লাগিয়ে খুব জোরে দম ছাড়া হতো। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের টিপলা দিয়ে চোঙ্গার মুখ কষে বন্ধ করা হতো, যাতে বাতাস বের হয়ে আসতে না পারে। তারপর আবশ্যক মতো পানি ও তামাক পান করে চোঙ্গাটা আবার মুখের কাছে ধরা হতো। খুব ক্ষিপ্র হাতে চোঙ্গার টিপলাটা খুলে মুখ লাগিয়ে চুষে চোঙ্গায় বন্ধ রোজা মুখে আনা হতো এবং ঢোক গিলে একেবারে পেটের মধ্যে ফেলে দেয়া হতো। খুব ধার্মিক ভালো মানুষ দু'একজন এমন করাটা পছন্দ করতেন না বটে কিন্তু সাধারণভাবে সে সময় এটাই চালু ছিল।'

'তাবাকাৎ-ই-নাসিরি'র লেখক ঐতিহাসিক মিনহাজ উস-সিরাজ সেকালের ঈদ উৎসব সম্পর্কে জানিয়েছেন, 'বাদশাহ ধর্মীয় আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন, ঈদের নামাজ পড়ানোর জন্য নিয়োগ করতেন ধর্মীয় ইমাম। শহরের বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো এবং এসব স্থানকেই ঈদগাহ নামে অভিহিত করা হতো।'

আগেই বলা হয়েছে ঈদ সম্পর্কে আমরা সেকালে যে বিবরণ পাই তা থেকে ধরে নেওয়া যায় রমজান মাস থেকেই শুরু হতো ঈদের প্রস্তুতি। এ উৎসব শুরু হতো রমজানের চাঁদ দেখা থেকে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না।

আবুল মনসুর আহমেদ সেকালে ঈদের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে আরও বলেছেন, 'এই অঞ্চলে কোনো মসজিদ বা জুমার ঘর ছিল না। বছরে দুইবার ঈদের জামায়াত হইতো বটে কিন্তু তাতে বড়রাই সামিল হইতো। তাই জামাতে খুব অল্প লোকই দেখা যাইতো। সাধ্যমতো নতুন কাপড় চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান বাজনা করিত। সারারাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইতো। প্রায়ই বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডাগর দেখা যাইতো। ঈদের জামাতেও লোকেরা কাছা, ধুতি পরিয়াই যাইত। নামাজের সময় কাছা খুলিতেই হইতো। সে কাজটাও তাহারা নামাজে দাঁড়াইবার আগেতক করিত না। প্রথম প্রথম নামাজের কাতারে বসিবার পর অন্যের অগোচরে চুপি চুপি কাছা খুলিয়া নামাজ শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই আবার কাছা দিয়া ফেলিত'।

অজ্ঞতা ও কুসংস্কার তখন বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিদারুণভাবে গ্রাস করে। তারা সহজ-সরল ইসলাম ভুলে গিয়ে রমজানে ও ঈদ উৎসবের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বহু কুপ্রথা, অন্ধবিশ্বাস, ইসলামবিরোধী আচার-অনুষ্ঠানে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে সময় সত্যিকারের ইসলাম হারিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত থেকে অন্ধকারের অতল তলে হারিয়ে যায়। তখনকার মুসলমানদের সমাজে এই অধঃপতন দেখে সে সময়ে ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা হাজী শরীয়তুলস্নাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। জেমস ওয়াইজ আরও লিখেছেন দীর্ঘকাল হিন্দুদের সংস্পর্শে থাকার ফলে ঈদ উৎসবের ধর্মীয় ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের মতো যেসব কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস প্রবেশ করে তার বিরুদ্ধে হাজী শরীয়তুলস্নাহ সর্বপ্রথম আন্দোলন আরম্ভ করেন। তিনি ইসলাম ধর্মের বহু দেব-দেবী, ভ্রান্ত অলীক বিশ্বাসও পাপপূর্ণ নতুন প্রথাগুলোর উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করেন। এভাবে হাজী শরীয়তউলস্নাহ দীর্ঘকাল ধরে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজ থেকে বহু অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করেন।

এ শতকের তৃতীয় চতুর্থ দশকের গ্রামাঞ্চলে ঈদ পালনের কয়েকটি বর্ণনা পাই খন্দকার আবু তালিবের নিবন্ধ থেকে 'রোজার পনেরো দিন যাওয়ার পর হতেই গৃহবধূরা নানা রকম নকশি পিঠা তৈরি করতে শুরু করত। এদের মধ্যে ফুল পিঠা, পাপর পিঠা, ঝুরি, হাতে টেপা সেমাই ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। শবেকদরের রাতে মেয়েরা মেহেদী এনে তা বেটে হাতে নানা রকম চিত্র আঁকত। ফুল পিঠা তৈরি করার সময় বউয়েরা 'প্রিয় স্বামী', আর অবিবাহিত মেয়েরা 'বিবাহ' ও 'প্রজাপতি' এঁকে রাখত। ঈদের দিনে যুবক-যুবতী বন্ধু-বান্ধবীদের পাতে দেওয়ার জন্যই এ ধরনের ফুল পিঠা তৈরি করা হতো'।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আগেও যেমন বঞ্চিত ছিলেন ঈদের আনন্দ থেকে এখনো বঞ্চিত আছেন তদ্রূপ, প্রতিনিয়ত, মোগল আমলের ইতিহাসে আমরা দেখেছি বিত্তবানরা ঈদের দিন ছুড়ে দিচ্ছেন রেজগি পয়সা আর সাধারণ, নিরন্ন, বঞ্চিত মানুষ তা কুড়িয়ে নিচ্ছেন কাড়াকাড়ি করে। এখনো তার এ আমলে কোনো হেরফের হয়নি বরং বঞ্চনা আরও বেড়েছে। আমরা চোখের সামনে দেখেছি বাংলাদেশে ধনীর গৃহে জাকাতের কাপড় নেওয়ার জন্য ছিন্নমূল মানুষের হুটোপুটি লাইন তা আমাদের হতভাগ্য, বঞ্চিত, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের চেহারাই তুলে ধরে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের আনন্দ সাধারণ মানুষের মনে আজ আর কোনোই রেখাপাত করে না। ঈদুল ফিতরের জামাতের আগে থেকেই বিত্তবানদের ফেতরার অর্থ ও সাহায্য নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় শত শত ছিন্নমূল মানুষকে। উৎসব সর্বাঙ্গীণ আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে তখনই যখন আসে বিত্ত বণ্ঠনের সামঞ্জস্য। তা নাহলে ধর্মীয় উৎসব (ঈদুর ফিতর) মূল আবেদন হ্রাস পায়।

ফরায়েজী আন্দোলন এবং পরবর্তী ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলো পাল্টে দিতে পেরেছিল বাংলাদেশের এই মুসলমানদের মনমানসিকতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লৌকিক, স্থানীয় উপাদানগুলো বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছে ঈদের সঙ্গে। অনেকে এসেছে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন উৎসব ও লোকাচার থেকে।

এই শতকের শুরু থেকেই যখন রাজনৈতিকভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। বাংলাদেশের দুটি ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। করোনার সময়ে অবশ্য পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। ঈদ উৎসব হয়তো আগের মতো প্রাণবন্ত হবে না। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে