''ইচ্ছে ছিল আবার একবার জন্মভূমিতে যাব; কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতু্যতে সে ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয়েছিল। মনে পড়ে, তিনি বারবারই বলেছিলেন থেকে যেতে। বলেছিলেন, 'আপনারে ছাড়ুমই না।' উত্তরের বলেছিলাম, আমার গ্রামের বাড়িতে উদ্বাস্তু, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে থাকার জায়গা কোথায়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'ছাইড়া দ্যান। আমি আপনেরে বাড়ি দিমু, গাড়ি দিমু, ডোমিসিল দিমু।' তিনি বলেছিলেন, আপনার থাকার জায়গার অভাব হবে না। সে আমিও আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করেছি।''
১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো যখন রবীন্দ্রসংগীতের প্রণম্য শৈলজারঞ্জন আসেন তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়। একপর্যায়ের দু'জনের মধ্যে উপরোক্ত কথাগুলো হয়। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'যাত্রাপথের আনন্দগান'-এর ১৩৪ পৃষ্ঠায় এভাবে উলেস্নখ করেছেন। উলেস্নখ, বইয়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদার যেভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম লিখেছেন উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে সেভাবেই রাখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাক্য-বিনিময়ে আমরা তার মধ্যে এক ধরনের পিতৃভিটা হারানোর দীর্ঘশ্বাস লক্ষণীয় এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। আমৃতু্য হয়তো এই দীর্ঘশ্বাস তাকে পীড়া দিয়েছে। তিনি ১৯৯২ সালের ২৪ মে গত হওয়ার পূর্বে- পরে তার জন্মভূমি নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের মাঝে অনুসূচনার জন্ম দিয়েছে। স্থানীয় সাহিত্য সাময়িকী ও ইতিহাসগ্রন্থে প্রাসঙ্গিক হতে থাকেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। নেত্রকোনার কবি ও লেখকদের আত্মজীবনীতেও শৈলজারঞ্জন মজুমদার ওঠে আসেন। অধ্যাপক যতীন সরকার বিরামহীনভাবে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের বিষয়ে সভা-সেমিনারে বলে গেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার আত্মজীবনী গ্রন্থ 'আমার কণ্ঠস্বর'-এ শৈলজারঞ্জনের প্রসঙ্গ টেনেছেন অনেক আগেই এবং পরবর্তী সময়ে তার সৃষ্ট কাশবনের গানের স্কুলটির নামও শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নামে করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ 'মধ্যাহ্ন' উপন্যাসে শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে প্রাসঙ্গিক করেছেন। নেত্রকোনার প্রবীণ সাংবাদিক শ্যামলেন্দু পাল ও জালাল আহমেদ ইত্তেফাক ও সংবাদে শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে একাধিকবার লিখেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় লেখালেখি চলছে এখনো। ইতোমধ্যে দুই বাংলার লেখক-গবেষকদের লেখা নিয়ে 'শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্মারকগ্রন্থ' ও 'শৈলজারঞ্জন মজুমদার রচনাসমগ্র' প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিক ও গবেষক সঞ্জয় সরকার 'শৈলজারঞ্জন মজুমদার জীবনীগ্রন্থ' প্রকাশ করেছেন। এ বি বিপস্নব দীর্ঘদিন ধরে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ করছেন। ছোট কাগজ কংস এক্সপ্রেসের উদ্যোগে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ১১২তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন পরিষদ-২০১২ সালের ১৯ জুলাই মোহনগঞ্জে দিনব্যাপী শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে। এই আয়োজনের আহ্বায়ক করা হয়েছিল কবি, নাট্যকার ও ছড়াকার রইস মনরমকে। এতে ভারত-বাংলাদেশের বিশিষ্ট জনরা উপস্থিত ছিলেন। প্রোগ্রামটিতে মোহনগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, নারী অধিকার কর্মী, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের অকৃপণ সহায়তা ছিল। ছিল কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাও। এই আয়োজনে ব্যানার, পোস্টার ও আমন্ত্রণপত্রের ডিজাইন করেছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী। শুধু তাই নয়, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মজয়ন্তীর প্রাথমিক আলোচনায় তিনি ছিলেন। মনে পড়ে, কাটাবন থেকে কাঁধে করে পোস্টার, ব্যানার ও আমন্ত্রণপত্র শাহবাগে দিয়ে গিয়েছিলেন।
মোহনগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষরা শৈলজারঞ্জনের বাড়ি উদ্ধারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে। কাজ করেছে বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পৃক্ত স্থানীয় প্রতিনিধিরা। এ ক্ষেত্রে মোহনগঞ্জের সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোজাম্মেল হকের আন্তরিকতা ছিল লক্ষণীয়।
ধারাবাহিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের আমৃতু্য চাপা কষ্টের লাঘব করেন শৈলজারঞ্জনের পরম সুহৃদ সাবেক গণপরিষদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের সুযোগ্য সন্তান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও সাবেক সিনিয়র সচিব, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান। শৈলজারঞ্জনের ভিটাবাড়ি উদ্ধারে সহায়তা ও লাগাতার লেখালেখির মাধ্যমে শৈলজারঞ্জনকে আরও বেশি করে সুধীজনের দৃষ্টিতে নিয়ে আসনে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আর তার অনুজ সাজ্জাদুল হাসান করেন সবচাইতে বড় কাজটি। জমি উদ্ধার পর্ব সম্পাদন করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিশাল সমারোহে তিনি গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন শৈলজারঞ্জন মজুমদার সংস্কৃতি কেন্দ্র। যেখানে হবে দুই বাংলার রবীন্দ্র অনুরাগী তথা সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের মিলনস্থল। ইতোমধ্যে এই সংস্কৃতি কেন্দ্রের নব্বইভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। শিগগিরই এটির আনন্দযাত্রা শুরু হবে। এর মধ্য দিয়ে শৈলজারঞ্জনের প্রতি আমাদের কিছুটা হলেও দায়মুক্তি হবে। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ১৯৭৫ সালে শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে দেয়া তার প্রতিশ্রম্নতির কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন হবে।
রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপিকার, শিক্ষক ও সংগঠক শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯৩০ সালে মতান্তরে ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনের বাইরে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও পৃথিবীতে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করে নেত্রকোনাবাসীকে গর্বিত করেছিলেন। যার ফলে রবীন্দ্রনাথ কখনো না এলেও রবীন্দ্রসাহিত্যে নেত্রকোনা স্থান পেয়েছিল। চার অধ্যায় উপন্যাস, শ্যাললি কাব্যগ্রন্থেও উৎসর্গপত্র এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
সেই রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজনস্থল নেত্রকোনার দত্ত স্কুল ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আজও তার স্মৃতিস্মারক তৈরি হয়নি। হয়তো সে কাজটিও বাদ থাকবে না। রবীন্দ্রনাথের মতে যিনি 'ভরি লয়ে সংগীতের সাজি'তে আমাদের মাঝে এসেছিলেন 'বিজ্ঞানের রসায়ন ও রাগরাগিণীর রসায়নে' যার জীবন পূর্ণ ছিল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যিনি ছিলেন 'গীতাম্বুধি' সেই শৈলজারঞ্জন মজুমদারের প্রয়াণবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
মুহম্মদ আকবর : লেখক, গবেষক