বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা জরুরি

নতুনধারা
  ১৩ জুন ২০২১, ০০:০০

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। পৃথিবীর কোনো দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের সর্বক্ষেত্রে এমন উন্নতি সাধন করেছে কিনা তার ইতিহাস বিরল। সবদিক দিয়েই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান বলা চলে। এত উন্নতির মধ্যেও বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো জনসংখ্যা। ভৌগোলিক অবস্থানের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা বহুল। কিন্তু বহুল জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়েও দেশের অবস্থান বিশ্ব মানচিত্রে শক্ত করা সম্ভব তা খুব বেশি দেশ দেখাতে না পারলেও কিছু কিছু দেশ তা করে দেখিয়েছে। এই বহুল জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন উচ্চতর করা যায় তার প্রধান উদাহরণ হলো চীন। চীন পৃথিবীর সব থেকে জনসংখ্যা বহুল দেশ হয়েও তাদের জনসংখ্যাকে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের জনগণকে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নতি সাধন করাকে বলা হয় মানবসম্পদ। মূলত মানবসম্পদ বলতে কর্মদক্ষতাকে বোঝায়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, কোনো দেশের জাতীয় আয় (এঘচ) যেমন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তেমনিভাবে দেশের মানুষের গুণগত মানের সঙ্গে ও সম্পৃক্ত। অর্থাৎ সমাজের বসবাসকারীদের ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। দেশের জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করার যে প্রচেষ্টা সেটাই মানবসম্পদ।

বলা হয়ে থাকে- বাংলাদেশ তারুণ্যের জয়গানময় দেশ। এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই ২৪ বছরের নিচে অর্থাৎ অর্ধ-শতাংশের কাছাকাছি তরুণ। সচরাচর যেসব দেশে তরুণের সংখ্যা বেশি থাকে সেসব দেশ সম্ভাবনাময় হয়ে থাকে। এই তরুণসমাজকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণসমাজকে দক্ষ মানব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের দক্ষ মানব হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য তাদের প্রস্তুত করে তুলতে হবে। বর্তমান সময়ে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে কারিগরি শিক্ষা, কৃষি খাত ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা আবশ্যক। আর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন আত্মোন্নয়নমূলক দক্ষতা থাকা জরুরি। তাই তরুণদের দক্ষ মানব হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ব্যক্তিগত পদক্ষেপ যেমন জরুরি তেমন সরকারি পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।

বর্তমান উন্নত বিশ্বে শিল্প-কারখানার পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রেও খুবই জোর দিচ্ছে। কৃষিপণ্য কীভাবে অল্প খরচে কম সময়ে অধিক ফলন পাওয়া যায় সেদিকে অধিকাংশই দেশ কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণত দেখা যায় উন্নত বিশ্বে শিক্ষিতরাই কৃষিপণ্য উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, কিন্তু বাংলাদেশে একেবারে তার ঠিক উল্টো চিত্র চোখে পড়ে। বাংলাদেশে অশিক্ষিতরাই কৃষি কাজ করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর কিছু হেরফের দেখা যাচ্ছে। ছাত্রসমাজ এখন পড়ালেখার পাশাপাশি কৃষিপণ্য উৎপাদন করে নিজের খরচের জোগান দিচ্ছে এরকম হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। সারাদিন পড়ালেখা নিয়ে থাকতে হবে এই চিন্তা-ভাবনা থেকে ছাত্রসমাজ আস্তে আস্তে সরে আসছে। ছাত্র থাকাকালেই ছাত্ররা নানারকম উন্নয়নমূলক কাজ ও নিজের ভরণপোষণ নিজেই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাপ-দাদার বসতবাড়িতে অকাজে পড়ে থাকা জায়গাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্ররা নানারকম শাক-সবজি উৎপাদন করে যাচ্ছে। এতে পরিবারের ভরণপোষণ পুরোপুরি সামাল দিতে না পারলেও নিজের খরচ নিজেই জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ছাত্রদের যে এই স্পৃহা সেটাকে কাজে লাগাতে হবে সরকারের। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে নজরদারি করে ছাত্রসমাজ যেন এসব উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে আরও বেশি দক্ষভাবে জড়িত হতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সেটা হতে পারে প্রত্যেক ইউনিয়নে কৃষি অফিস স্থাপন নিশ্চিত করে ছাত্রসমাজকে যেন উদ্বুদ্ধ করা যায় তার জন্য কৃষি বিষয়ে পারদর্শী জনবলকে মাঠপর্যায়ে কাজ করার মাধ্যমে। কৃষি কর্মকর্তা এলাকায় গিয়ে ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেবে, প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি ঋণের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেবে। এতে ছাত্রসমাজ যেভাবে দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকবে তেমনিভাবে ছাত্রসমাজ দক্ষ মানবসম্পদেও পরিণত হবে।

আজকাল এলাকায় এলাকায় দেখা যায় সচেতন ছাত্ররা বসে না থাকে বাসার ছাদে বা ছোট্ট ছোট্ট কোনো কোনো জায়গায় বায়ো ফ্লোক বা বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে মাছ উৎপাদন করছে যা আমাদের মৎস্য চাহিদা জোগানে বেশি ভূমিকা না রাখলেও কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র থেকে সৃষ্টি হবে বৃহৎ কিছুর। তাই মৎস্যবিষয়ক সহায়তা ও প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের দক্ষ জনবলকে কাজে লাগাতে হবে। এতে ছাত্রসমাজ তাদের স্বীকৃতিস্বরূপ অনুপ্রেরণা পাবে। এতে ছাত্রসমাজ আরও বেশি জোরালোভাবে এসব কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে। তাছাড়া অন্য ছাত্রদেরও এই বিষয়ে ধারণা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারে, এবং প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমানে ঘরে বসেই বিশ্বের নানা প্রান্তের কোম্পানির বা ব্যক্তির নানারকম ডকুমেন্টস তৈরি, গ্রাফিকসের কাজ, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করে দিয়ে অর্থোপার্জনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। ঘরে বসে অর্থের বিনিময়ে স্বাধীন চিন্তায় বহির্বিশ্বের কাজ করে দেওয়াকে ফ্রিল্যান্সিং বলে। যেহেতু এই কাজের মধ্যে নিজের স্বাধীনতা ও ভালোমানের অর্থোপার্জন হয় তার কারণে ছাত্রদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। এবং ফ্রিল্যান্সিং জগতে কাজ করার সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু দিন দিন বহির্বিশ্বেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণে প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। তাই বাংলাদেশের ভালো অবস্থানকে দৃঢ় করতে হলে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার এর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যা পর্যাপ্ত নয়। আর তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো এরকম কাজ সম্পর্কে শহরের ছাত্ররা যেরকম অবগত আছে তার ছিটেফোঁটাও গ্রামে থাকা ছাত্ররা জানে না। তাই গ্রামপর্যায়ে এর প্রচার, প্রসার করতে হবে। তাছাড়া বর্তমান সময় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। দিন দিন এর প্রতি নির্ভরতা বেড়েই চলেছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষ না হলে উন্নয়ন নিম্নমুখী হওয়া থেকে নিস্তার করা সম্ভব হবে না। তাই তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে খুবই জোরালো পদক্ষেপ না নিলে এর জন্য খেসারত দিতে হবে। সরকারের উচিত এই বিষয়ে নজর দিয়ে দেশের ছাত্রসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারার জন্য যোগ্য করে তোলা।

সরকারের ছাত্রসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা জরুরি। বিশ্বায়নের যুগে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ছাত্রসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে এখন থেকে কাজ করতে হবে সরকারের ও ছাত্রদের। সরকারের যেরকম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেমন জরুরি ঠিক তেমনি ছাত্রদেরও এই বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে হবে। নিজেদের গড়ে তুলতে ও দেশকে এগিয়ে নিতে ছাত্রদের সোচ্চার হওয়া জরুরি। তারুণ্যের জয়গান নিয়ে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এমনটি প্রত্যাশা রাখি।

সাজ্জাদ হোসেন রায়হান

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে