রোহিঙ্গারা ফিরে পাক নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মিয়ানমারে দীর্ঘ ৫০ বছর পর ২০১১ সালে অং সান সুচির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও জনগণের অভূতপূর্ব সাড়ায় গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সুদীর্ঘকাল সামরিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে ক্লান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আশাটুকুর সঞ্চার হয়েছিল- এবার তারা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের অধীনে সুখীসমৃদ্ধ পূর্ণ জীবনযাপনের দিকে অগ্রসর হবে। কিন্তু সে আশা ক্ষীণ হয়ে আসে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাদর্পে। গত ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) প্রায় ৮৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয় লাভ করে। ইতোপূর্বে মিয়ানমারের সংবিধানে সেনাবাহিনীর জন্য এক-চতুর্থাংশ পৃথক সংসদীয় আসন বরাদ্দ থাকলেও সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি নামক একটি রাজনৈতিক দল আছে। বিগত নির্বাচনে এই সেনা-সমর্থিত দলের ভরাডুবি হয়। এদিকে প্রায় ২০১৫ সাল থেকেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুচির একটি অঘোষিত দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। সুচি বরাবরই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাসে তৎপর ছিলেন। নির্বাচনে এরূপ দুর্দশা দেখে সেনাবাহিনী দেশীয় রাজনীতিতে মারাত্মক অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে সন্দিহান হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে গত ১ ফেব্রম্নয়ারি ২০২০-এ সেনাবাহিনী দ্বারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অপসারিত হন। দেশের সাধারণ মানুষ যা মেনে নিতে পারেনি। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের জনসাধারণ। বিক্ষোভ প্রতিবাদ দমনে সেনাবাহিনী জনগণের উপর নির্মম দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়। সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্ট সাক্ষ্য দেয়, গত চার মাসে নারী-শিশুসহ আট শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে সেনাদের বর্বরতায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কূটনৈতিক চাপেও সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং নমনীয়তা প্রদর্শন করছে না বা তার মধ্যে সমঝোতার আভাসও অনুপস্থিত। ইতোমধ্যে বিগত নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদের একাংশ গত ১৬ এপ্রিল জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করে। উলেস্নখ্য, এই জাতীয় ঐক্যের সরকার-এ ক্ষমতা হারানো সুচির দল এনএলডি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিসহ অন্যান্য ছোট ছোট রাজনৈতিক দলও আছে। এখন তারা বহির্বিশ্বে চরিত্র পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জোরালো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোপূর্বে এটা সবাই জ্ঞাত যে সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হলো রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর উপর হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং সর্বোপরি বাস্তুচু্যতি। সেনাবাহিনীর অভু্যত্থানে ক্ষমতা হারানো সুচির দল এনএলডিসহ বিরোধী দলগুলোর একটি জাতীয় মোর্চা কয়েকদিন আগে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি বিশেষ রিপোর্ট পেশ করে। যা বিগত কয়েক বছর আগের নীতির সঙ্গে পুরোপুরি দ্বান্দ্বিক। রোহিঙ্গা নিধনে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করলেও সুচির প্রকট সমর্থন ছিল। যার প্রমাণ মেলে আন্তর্জাতিক আদালতে সেনাবাহিনীকে গণহত্যার দায় থেকে বাঁচাতে তার নিরলস প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে। এটা এখন প্রকটরূপে প্রতীয়মান যে সুচির দল এনএলডির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যের সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করলেও মিয়ানমারের কার্যত কোনো সরকারের রূপ নিতে পারেনি। এটা এখনো একটা সমান্তরাল সরকার। তাদের কার্যকর রূপ নিতে হলে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে তেমন কোনো উলেস্নখযোগ্য সাফল্য লক্ষ্য করা যায়নি। যেহেতু জাতীয় ঐক্যের সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে মরিয়া সেহেতু ইতোপূর্বে তাদের মধ্যে থাকা আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। গত মাসে জাতীয় ঐক্যের এক দূত যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন রোহিঙ্গা ইসু্যতে। জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রতিনিধিকে রোহিঙ্গা ইসু্যতে অবস্থান স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে তাদের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি রোহিঙ্গা ইসু্যতে তাদের অবস্থান পশ্চিমাদের মনঃপুত না হলে তারা সহানুভূতি পাবে না। এটা আদতে আন্তর্জাতিক চাপ। কিন্তু গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ের বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর দমনমূলক নীতির কারণে দেরিতে হলেও মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে এই বিশ্বাসের সঞ্চার হয়েছে সেনাবাহিনী সত্যিই বিধ্বংসী। তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজেদের জনগণের রক্ত ঝরাতেও পশ্চাৎপদ হয় না। তাই তারা রোহিঙ্গা ইসু্যতে সেনাবাহিনীর দমনমূলক কর্মকান্ডের বিচার চাইছে। কারণ কয়েক বছর আগে সেনাবাহিনী রাখাইনে যে নারকীয় হত্যাকান্ডের জন্ম দিয়েছিল ঠিক সেইরূপ হত্যাকান্ড চালাচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে। প্রকাশিত 'পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট'-এর উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি দিক হলো- (ক) এ অবস্থানপত্রের আগে শুধু রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্য করে সুস্পষ্ট কোনো সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি। যা মিয়ানমারের অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আলাদা মর্যাদা ও গুরুত্ব বহন করে। (খ)) এ অবস্থান পত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এই প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর আগে রাখাইনের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তারা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত বাঙালি বা মুসলমান বলে অভিহিত করত। (গ) জাতীয় ঐক্যের সরকার তাদের প্রস্তাবিত 'ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'-এ নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সব জাতিগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করছে। কিন্তু এর আগে ১৯৮২ সালের আইন দ্বারা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার বিলোপ করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ রোহিঙ্গারা সমস্ত নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এবং (ঘ) সর্বোপরি গত দশ বছরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গারা যে অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে তার প্রতি নিন্দা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে, গভীর দুঃখ প্রকাশ করাও হয়েছে। যা এর আগে পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি থাগিশ মিলিটারিকে বিচারের আওতায় আনার ও সুপারিশ করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের সরকারের এ অবস্থানপত্রে বিধৃত প্রতিশ্রম্নতিগুলো রোহিঙ্গাদের এযাবৎকালের সকল ক্লেশ দুর্দশা ও দুর্বিষহতার অবসানকল্পে যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, জাতীয় ঐক্যের সরকার এখনো মিয়ানমারের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রেও তাদের ফল আশানুরূপ নয়। কিন্তু আমরা আশাবাদী এই প্রেক্ষাপটে যে, জাতীয় ঐক্যের সরকার মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার। দেশটির প্রায় সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আছে এই আন্দোলনে। এ সত্ত্বেও এই জাতীয় ঐক্যের সরকারের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হলো এখানে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি থাকলেও রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর কেউ নেই। অর্থাৎ বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এই ঐক্য যতটা প্রতিনিধিত্বমূলক ও কার্যকর হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি। আমরা ১০ লাখ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর আশ্রয়দানকারী ও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এই কামনা করি যে অতি শিগগিরই মিয়ানমারের সাধারণ জনগণসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নেতার মানবিক ভাবোদয় হবে এবং বাস্তুচু্যত এসব রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মানুষ নিজ বাসভূমিতে প্রত্যাবাসন করবে। সঙ্গে ফিরে পাবে তাদের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার। সিরাজুল ইসলাম সোহাগ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়