শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক অবক্ষয় ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে সালাম সালেহ উদদীন

যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে-তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
নতুনধারা
  ১৬ জুন ২০২১, ০০:০০

সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করেছে। হেন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে অবলীলায় হত্যা করছে। স্ত্রী স্বামীর লাশ ছয় টুকরা করে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। স্বামী ঠুনকো কারণে স্ত্রীকে সন্তানসহ হত্যা করছে। এমনকি প্রেমের কারণে অর্থ সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বঞ্চনা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা-মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে নিজের সন্তানকে হত্যা পর্যন্ত করছে। পারিবারিক বন্ধন স্নেহ, ভালোবাসা মায়া-মমতা, আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ। এর পাশাপাশি করোনাকালে সমাজে ধর্ষণ গণধর্ষণ ও নারী নির্যাতন অবমাননা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির।

সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে এক নারী ও তার শিশুসন্তানসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সৌমেন রায় নামের পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শককে (এএসআই) আটক করেছে পুলিশ। তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সৌমেনকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্ত্রী পরকীয়ায় আসক্ত, এই সন্দেহে এই হত্যাকান্ড ঘটে। এ কেমন বর্বরতা? স্ত্রী যদি অপরাধ করেই থাকে, তা হলে তাকে শাস্তি দেওয়ার নানা উপায় রয়েছে। তা ছাড়া দেশে আইন রয়েছে। আইন অনুসারে অপরাধীর শাস্তি হবে। অথচ সৌমেন রায় পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শক হয়ে কী করে এমন নিষ্ঠুর হত্যার ঘটনা ঘটাতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। অবশ্য পুলিশ বর্তমানে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এই হত্যাকান্ড তারই ধারাবাহিকতা।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সমাজের স্বাভাবিক ও সুস্থ গতিপ্রবাহ রক্ষা করার দায়িত্ব কার, সরকার, স্থানীয় সরকার, সমাজপতি নাকি সমাজের সচেতন মানুষের। সমাজ পুনর্নির্মাণের দায়িত্বই বা কার? আপতদৃষ্টিতে এই সব প্রশ্ন সহজ মনে হলেও এর সমাধান বেশ জটিল। সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বাস করে, বিচিত্র এদের মানসিকতা ও রুচি। এদের কোনো সমান্তরাল ছাউনির মধ্যে আনা কঠিন। তবে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক অপরাধ কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে। সমাজ রক্ষা করা না গেলে পরিবার রক্ষা করা যাবে না, ব্যক্তিকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা করা জরুরি। সমাজ পরিবর্তন মানে সামাজিক কাঠামো ও সমাজের মানুষের কার্যাবলি এবং আচরণের পরিবর্তন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন।

বিয়ের পর একজন নারীর সবচেয়ে ভরসাস্থল ও নিরাপদ জায়গা হচ্ছে তার স্বামী। সব ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক বৈরী পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে রাখার কথা যে স্বামীর, যে স্ত্রীর স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা একজন স্বামীকে ঘিরে, সেই স্বামীই হয়ে ওঠে লোভী, ভয়ঙ্কর, নির্যাতক, শোষক ও হন্তারক। আবির চ্যাটার্জি ও নুসরাত জাহান অভিনীত ভারতীয় বাংলা ছবি ডিকশনারি। এই ছবিতে দেখা যায় স্ত্রী নুসরাত জাহান পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন আবিরের কলেজের জুনিয়র এক ছাত্রের সঙ্গে, যিনি চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসেন। যার স্থানীয় অভিভাবক এই পরিবার। আবির তাদের সম্পর্কের গভীরতা টের পেয়েও স্ত্রীকে কিছু বলেন না। এমনকি প্রেমিকের বিয়ে ঠিক হলে স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তাকে সাহস ও সান্ত্বনা জোগায় স্বামী আবির। শেষে স্ত্রী তার অপরাধ স্বীকার করেন এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হন। আবির বলেন, স্বামীর যে কর্তব্য তা তিনি যথাযথ পালন করতে পারেননি। তার স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, উদারতা, মহানুভবতা ও মানবিকবোধ শিক্ষণীয়। সিনেমার শেষে দেখা যায়, আবির লাইব্রেরিতে ডিকশনারি দেখছেন। স্ত্রীকে তিনি বলেন, স্বামী শব্দের অনেক সমার্থক শব্দ রয়েছে, তার একটি হলো শিক্ষক। ছাত্র ভুল কিংবা অপরাধ করলে শিক্ষক যেমন শুধরে বা ক্ষমা করে দেন, একইভাবে স্বামীর কর্তব্যও হওয়া উচিত তাই। স্ত্রীকে নির্যাতন, হত্যা করা নয়। অথচ বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে একটু অপরাধ পেলেই স্ত্রীকে মেরে ফেলা। একইভাবে স্ত্রীরাও অর্থের প্রলোভনে ও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে প্রেমিকের সাহায্যে স্বামীকে হত্যা করছে। একের পর এক সংসার ভেঙে যাচ্ছে। শিশু-সন্তানরা বাবা-মা হারিয়ে এতিম ও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ।

আসলে আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এমনকি যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্রও নিরাপত্তাদানে অপারগ। আমরা নানারকম সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কি সামাজিক ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- সবক্ষেত্রেই অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি, যা একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা স্বাধীন ও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কল্পনা করতে পারছি না। এ অবক্ষয় ইদানীং আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে এবং সমাজ কাঠামোকে নড়বড়ে করে ফেলছে।

সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যা বর্তমান সমাজে প্রকট। মনে রাখতে হবে বিশৃঙ্খল সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। আমরা চাই পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? দায়ী আমরাই। আমরাই নিজেকে সুপথে পরিচালিত করতে পারছি না। এর পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দখল ও দলীয়করণের ব্যাপারটি তো দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে কে আমাদের পরিত্রাণ দেবে এবং কে-ইবা আমাদের পথ দেখাবে? নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যদি নৈতিক হয় তা হলে সন্তানরাও নৈতিক ও মানবিক হয়ে উঠবে। সামাজিক মূল্যবোধ আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা সাম্প্রতিক নানা অপরাধমূলক ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমরা দীর্ঘদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি ধর্ষণ হত্যার মতো বিপজ্জনক অপরাধমূলক প্রবণতা সমাজে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা প্রতিরোধের প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। এই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার ও সমাজকেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির বর্বর পাষন্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। এমনকি শিশুর জীবনও চলে যাচ্ছে আপনজনের হাতে। এই অবক্ষয়ের আরেক চিত্র ইদানীং সমাজে শিশু হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়া। আমাদের কোমলমতি শিশুরা কোনো দিক থেকেই এখন আর নিরাপদ নয়। নানা কারণে তাদের জীবনঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে। কখনো তারা দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে অথবা অপহরণ ধর্ষণ ও হত্যার নিষ্ঠুর শিকার হচ্ছে, আবার কখনো তারা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এই ধরনের দুঃখজনক ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অপার সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে যে শিশুর নিরাপদে বেড়ে ওঠার কথা সেখানে কেন তাদের অকালে মৃতু্য হবে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কোনো ভূমিকা নেই?

এসব রোধ করতে না পারলে একদিকে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরাও থাকবে নিরাপত্তাহীন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে। সুতরাং সময় থাকতেই সাবধান হওয়া সমীচীন।

যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

\হআদর্শ ও গণমুখী রাজনীতি দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্ত অপরাধী পরিবেষ্টিত রাজনীতি। ক্ষমতা ও পেশিশক্তির বলে রাজনীতিকরা হেন কোনো অপরাধ নেই যে তারা করছেন না। এর প্রভাব পড়ছে সমাজে। ফলে সামাজিক অপরাধ তীব্র হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ এবং সামাজিক আন্দোলন বেগবান হলেই এর থেকে মুক্তি মিলতে পারে, অন্যথায় নয়।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে