সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ

ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধমর্, ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ধমর্ নয় আর আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বঁাধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই। যার ধমর্ যেটা, সে তাই পালন করবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা আর লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আমাদের দেশ আবারও প্রমাণ করল আমরা সম্প্রীতি চাই।

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

মাহমুদ আহমদ
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল থেকে বাংলা ভ‚খÐে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধমর্মতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পকর্ বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সা¤প্রদায়িক বা আন্তঃধমীর্য় স¤প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। যার যার ধমর্ স্বাধীনভাবে পালন করবেÑ এটাই ইসলামের শিক্ষা। কেননা একই আদম হাওয়া থেকে আমাদের সবার উদ্ভব। কে কোন ধমের্র অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হলো আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানব জাতি! আমি নর ও নারী থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর আমি বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার’ (সুরা আল হুজুরাত, আয়াত: ১৩)। এই আয়াত বিশ্বমানবের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মহাসনদ। জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অথবা বংশগত গৌরবের মিথ্যা ধারণা থেকে উদ্ভূত আভিজাত্যের প্রতি এ আয়াত কুঠারাঘাত করেছে। এক জোড়া পুরুষ-মহিলা থেকে সৃষ্ট মানবমÐলীর সদস্য হিসেবে সবাই আল্লাহতায়ালার সমক্ষে সমমযার্দার অধিকারী। চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মযার্দা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মযার্দার মূল্যায়ন হতে পারে না। মযার্দা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলি এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কতর্ব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্ব মানব একটি পরিবার বিশেষ। জাতি, উপজাতি, বণর্, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমÐলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচাযর্ বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করল। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সবোর্চ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সবাের্পক্ষা বেশি ধমর্পরায়ণ’ (বায়হাকী)। এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদশর্ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা-বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা-ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহŸান। ধমের্ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। যারা সামাজিক পরিমÐলে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, রক্তপাত ঘটায়, ধ্বংস যজ্ঞ এবং নৈতিকতা বজির্ত ইসলামিক কমর্কাÐ চালায়, তারা কখনো শান্তির ধমর্ ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হওয়ার দাবি সবাই ঠিকই করতে পারে, কিন্তু কাযর্কলাপে শ্রেষ্ঠত্ব না দেখালে তারা কখনো প্রকৃত-ইসলামের অনুসারী বলে আল্লাহর কাছে গ্রহণীয়তার মযার্দা পাবে না। পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধমের্র ব্যাপারে কোনো বল প্রয়োগ নেই। কারণ সৎ পথ ও ভ্রান্তি উভয়ের মধ্যে পাথর্ক্য সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে; সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে (পুণ্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী বিদ্রোহী শক্তিকে) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে নিশ্চয়ই এমন এক সুদৃঢ় মজবুত করে ধরেছে, যা কখনো ভাঙ্গবার নয়।’ আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবীগণ আল্লাহর নিদেের্শ পথহারা মানুষকে হেদায়াত দিতে থাকেন। যখন তারা স্বয়ং এ শিক্ষা দেন, তখন তারা শুধু ধমার্ন্তরিত হওয়ার কারণে কারো প্রতি বল প্রয়োগ বা জুলুম করা কিরূপে শিক্ষা দিতে পারেন? নবীগণের জামাতগুলোই নয়, তাদের মৃত্যুর শত শত বছর পরেও অনেক মহান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যাদের প্রতি সমসাময়িক আলেমগণ ধমের্র নামে জুলুম করেছিল। নবীগণের কতর্ব্য হলো খোদার বাণী মানুষের মধ্যে কেবল পেঁৗছে দেয়া। ধমর্ কখনো অশান্তি ও রক্তপাতের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় নাই। কোনো ধমর্ গ্রহণ বা বজর্ন করলে ইসলামে এর কোনো ধরনের শাস্তির বিধান নেই। শাস্তি দেয়ার মালিক হচ্ছেন একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা। হজরত নূহ (আ.) সমসাময়িক লোকদের ধমর্পথ ও পুণ্যের দিকে আহŸান করেন। তিনি কখনো কারো প্রতি অত্যাচার করেন নাই। নূহের বাণী শুনে লোকজন বলেছিল, ‘হে নূহ! যদি তুমি এই ধমর্ হতে বিরত না হও এবং তোমার চালচলন পরিবতর্ন না কর, তবে নিশ্চয়ই তোমাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে’ (সুরা শোয়ারা: রুকু ৬)। হজরত ইব্রাহীম (আ.) শান্তি, প্রেম, সহানুভ‚তি ও গাম্ভীযের্র সঙ্গে মানুষজনকে সত্যের পথে আহŸান করেন। তার হাতে তো কোনো তরবারি ছিল না, ছিল না জুলুম করার কোনো উপকরণ। তার জাতির লোকজন তাকে বলল, ‘যদি তুমি তোমার বিশ্বাস ও প্রচার পরিত্যাগ করো, তাহলে ভালো কথা, নচেৎ তোমাকে আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে ফেলব’ (সুরা মারইয়াম: রুকু ৩) অনুরূপ, হজরত লুত (আ.) ও হজরত শোয়েব (আ.) এর প্রতিও বিরুদ্ধবাদীগণ একই নীতি অবলম্বন করেছিল। আমরা সবাই জানি, আল্লাহর সমকক্ষ দঁাড় করানো ধমীর্য় দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ। কোরআন শরীফে আল্লাহর শরিক করার তথা তাকে অবমাননা করার অনেক উদাহরণ দেয়া আছে। কিন্তু কোথাও তার সমকক্ষ দঁাড় করানোর অপরাধে বা আল্লাহর প্রতি এক পুত্র-সন্তান আরোপ করার অপরাধে কোনো রকম জাগতিক শাস্তির বিধান দেয়া হয়নি। মহানবী (সা.) নিজেও খোদাতায়ালার অংশীদার দঁাড় করানোর কারণে কাউকে কখনো শাস্তি দেননি। এসব বিষয়ের মীমাংসা হবে পরকালে আর স্বয়ং আল্লাহতায়ালা এসবের বিচার করবেন, কোনো বান্দা করবে না। একইভাবে, পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-কে কাফেরদের পক্ষ থেকে যেসব ভাষায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো তারও অনেক উদাহরণ দেয়া আছে। যেমন, সুরা সোয়াদের ৪ নম্বর আয়াতে কাফেরদের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-কে ‘মহা মিথ্যাবাদী জাদুকর’ ও সুরা হিজরের ৬নম্বর আয়াতে ‘উম্মাদ’ বলে আখ্যায়িত করার কথা উল্লেখ করা আছে। আবার জালেমদের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-কে ‘জাদুগ্রস্ত মানুষ’ আখ্যায়িত করার কথা বলা আছে সুরা বনি ইসরাইলের ৪৭নম্বর আয়াতে (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিকা)। কিন্তু কোরআনের কোনো একটি স্থানেও এসব অবমাননাকর কথার জন্য জাগতিক কোনো শাস্তির নিদের্শ বা বিধান দেয়া হয়নি। একজন বিশ্বাসী মুসলমানের অন্তুর এসব কটূক্তির কারণে ক্ষত-বিক্ষত হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এসব গহির্ত অপরাধের বিহিত একমাত্র আল্লাহর হাতে। কোরআন কি অসম্পূণর্ বিধান যে আজ নতুন করে এমন ধমীর্য় অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান করতে হবে? বিশ্বাসের- স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধমের্র বিধান মতে ‘ধমর্’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এ ধমর্ একটি সুস্পষ্ট ধমর্। এই ধমর্ গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোনো জোর নেই, তবে এর বিচার সবর্শক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই করেন। ধমের্ যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকত, তাহলে হজরত রাসুল করিম (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদের ইসলাম ধমর্ গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নাই! এতে প্রমাণিত হয় যে, ধমের্র জন্য বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদশর্ হলো শত্রæর সঙ্গেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সবার সৃষ্টি যেহেতু একই উৎস থেকে তাহলে কেনো একে ওপরের সঙ্গে বিরোধ। আমার ধমের্র সঙ্গে, আমার মতের সঙ্গে আরেকজন একমত নাও হতে পারে, তাই বলে কি তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পকর্ খারাপ রাখার নিদের্শ ইসলামে রয়েছে? তাই আবারও বলতে চাই, ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধমর্, ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ধমর্ নয় আর আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বঁাধনে আবদ্ধ, এখানে কোনোরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোনো অপশক্তির স্থান নেই। যার ধমর্ যেটা, সে তাই পালন করবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা আর লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আমাদের দেশ আবারও প্রমাণ করল আমরা সম্প্রীতি চাই। মাহমুদ আহমদ: ইসলামী গবেষক ও সহ-সম্পাদক আহŸান সধংঁসড়হ৮৩@ুধযড়ড়.পড়স