নিশ্চিত হোক কৃষকের ন্যায্যমূল্য

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
দেশের সরকারি খাদ্য গুদামগুলোয় এ মুহূতের্ গত এক দশকের মধ্যে খাদ্যের সবোর্চ্চ মজুদ রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারি গুদামে মজুদ খাদ্যকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। খাদ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী গত সোমবার পযর্ন্ত সরকারি গুদামগুলোয় খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৬১৮ মেট্রিক টন; যার মধ্যে চাল ১৩ লাখ ৯০ হাজার ১২৪ ও গম ৪ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৪ মেট্রিক টন। এ মজুদ গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের বোরো মৌসুমে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের হার শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে আগামী বোরো মৌসুম পযর্ন্ত দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুযোর্গ না ঘটলে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হবে না। খাদ্য আমদানির জন্য যে অথর্ বরাদ্দ রয়েছে সেখান থেকে ৪ লাখ টন চাল ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করেছে খাদ্য অধিদফতর। এর ফলে আগামী বোরো ফসল কৃষকের ঘরে ওঠা পযর্ন্ত সরকারি সবকটি খাদ্য গুদামেই পযার্প্ত চাল মজুদ থাকবে। গত বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ মেট্রিক টন। এ চাল সংগ্রহের পর অতিরিক্ত আরও ৪ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করেছে সরকার। গত বছর এই সময়ে সরকারের গুদামে চাল ও গম মিলিয়ে মজুদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৪ মেট্রিক টন। এ বছর মজুদের পরিমাণ গত বছরের প্রায় তিন গুণ। দেশের সরকারি খাদ্য গুদামে পযার্প্ত চাল-গম মজুদ থাকা নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক ঘটনা। খোলা বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি মজুদ যেহেতু গুরুত্বপূণর্ ভূমিকা পালন করে সেহেতু আশা করা যায় আগামী বোরো মৌসুমের ফসল ওঠার আগে চাল বা গমের বাজারে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করবে। সরকারি গুদামে মজুদকৃত খাদ্যের মান রক্ষায়ও সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিকা মাল দরিয়া মে ঢাল তত্ত¡ যাতে মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠে সে বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্য উৎপাদন সন্তোষজনক হারে বাড়ছে। এ উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। তবে তার আগে কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করাও জরুরি। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, দেশে ফসলি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। আবাসিক চাহিদা, শিল্প কল-কারখানা স্থাপন, মাছ চাষ ও রাস্তাঘাট স্থাপনা তৈরির কারণে ফসলি জমির ওপর চাপ বাড়ছে। গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএস এইডের অথার্য়নে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১৯৭৬ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৯৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। ২০০০ সাল পযর্ন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৯ হেক্টর কমে দঁাড়ায় ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪১ হেক্টরে। কিন্তু পরবতীর্ মাত্র ১০ বছরে ২০১০ সাল নাগাদ ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর কমে মোট কৃষি জমির পরিমাণ দঁাড়িয়েছে ৮৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৭ হেক্টর। ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পযর্ন্ত ২৫ বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমেছে, পরের ১০ বছরে কমার পরিমাণ পঁাচ গুণ বেশি। ইউএনডিপির (২০০৩) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের (২০০৯) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি তথ্য সাভিের্সর (২০১৫) সূত্র উল্লেখ করে কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েব পোটাের্ল জানিয়েছে, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫০৫২৭৮.১৪ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭১২৪৮৯৫.৪১ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি ২০৪৩৬৬.১৪ হেক্টর। দেশজুড়ে প্রতিদিন কমছে কৃষি জমি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে নানা খবর ও প্রতিবেদন। দেশজুড়ে পাহাড় থেকে সমতল, বিল থেকে হাওর, চর থেকে উপক‚ল, বন থেকে বরেন্দ্র -নানাভাবে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। কৃষি জমি কমার কারণে গ্রামীণ বেকারত্ব বাড়ছে। দেশের মোট দরিদ্রের ৮২ শতাংশ লোক গ্রামে আর ১৮ শতাংশ শহরে বাস করে। এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠী কৃষি কাজের ওপর নিভর্র করে জীবন-জীবিকা চালায়। এখন আমাদের বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয় না দেশে পযার্প্ত খাদ্য উৎপাদন হওয়ায় এবং এতে বিদেশ নিভর্রতা কমছে আর গ্রামীণ কমের্ক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দেশে বতর্মানে ইটভাটার অধিকাংশই অবৈধ। যেখানে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। যদিও কয়লা পোড়ানোর আইনগত নিদের্শ থাকলেও সুযোগ পেয়ে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ভাটি মালিকদের সামাজিক অবস্থান এবং রাজ নৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এসব অ বৈধ ইটভাটা। যা আইনের তোয়াক্কা না করে স্থাপন করা হয়েছে লোকালয়, কৃষি জমি, পাহাড়ের ঢালে এবং বনাঞ্চলের আশপাশে। আবার কোথাও অবৈধভাবে কৃষি জমি এবং লোকালয়ে স্থাপন করা হয়েছে ইটভাটা। জমির উপরিভাগের দশ থেকে পনেরো ইঞ্চির মধ্যে থাকে পলিমাটি। যাকে বলা হয় মাটির প্রাণ। মাটি কাটার ফলে কমে যায় জমির উবর্রা শক্তি; যা পঞ্চাশ বছরেও পূরণ করা সম্ভব নয়। দেশে চাহিদানুযায়ী ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়। যার বেশিরভাগই কৃষি জমির উপরি ভাগ থেকে সংগৃহীত। ইট প্রস্তুতখ্যাত দেশের গ্রিন হাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস। এখাতে বছরে ২২ লাখ টন কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। যা বছরে ৮৮ লাখ টন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। ফসলি জমিতে ইটভাটি চালু করায় এর বিষাক্ত ধেঁায়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জমির ফসল। ইট যেহেতু পোড়াতে হয় দীঘর্ক্ষণ ধরে উত্তপ্ত আগুনে। তাই আশপাশের জমির পানি যায় শুকিয়ে এবং ভূগভর্স্থ পানির স্তর নামতে থাকে নিচে। আর প্রতিবছর কাবর্ন ডাই অক্সাইড নিগর্ত হয় সাত লাখ টন। বতর্মানে যে হারে বন উজাড় করে ভাটি তৈরি হচ্ছে, তা পরিবেশবিরোধী। কমে যাচ্ছে কৃষি জমি এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ইট তৈরির বিকল্প পথের সন্ধান। ইটভাটিতে বায়ুদূষণমুক্ত ইট তৈরির প্রযুক্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মাটির ইটের পরিবতের্ বিকল্প ইট তৈরি করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা অনুযায়ী ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার ২০২০ সালের মধ্যে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নদী খনন থেকে ওঠে আসা বালু দিয়ে ইটের বিকল্প উপকরণ দিয়ে ভবন নিমার্ণ কাজ করা যেতে পারে। সরকারি বিভিন্ন কাজে ইটের বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত হওয়া উপকরণ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেয়া সঙ্গত। ইটভাটির কারণে যে ভূমিক্ষয় হচ্ছে, তা রোধের উপায় বের করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায়ের জন্য কৃষি জমিসহ মাটির ব্যবহার রোধ করতে হবে। ইফতেখার আহমেদ টিপু ঢাকা