মেডিকেল বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি

প্রকাশ | ২৫ জুলাই ২০২১, ০০:০০

ফারিয়া জান্নাত শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
বর্তমান বিশ্বে উন্নত দেশগুলোতে 'ঝড়ষরফ ডধংঃব গধহধমবসবহঃ' বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানাসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য আবর্জনা এবং এদের ব্যবস্থাপনা ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে মেডিকেল বা চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বহির্বিশ্বে স্বাস্থ্য সচেতনতা বজায় রাখতে এই মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে; কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। আর এ ব্যাপারটিই দিনে দিনে খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ মেডিকেল বর্জ্য অবশ্যই মারাত্মক এবং বিপজ্জনক। যেহেতু প্রতিদিন প্রায় অনেক টন পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই বর্জ্যগুলোর বেশির ভাগ পরিমাণই কোনো ধরনের নিয়ম-কানুন ছাড়াই নদী-নালা, খাল-বিলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে অথবা নিয়ম ছাড়াই পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কিংবা মাটিতে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে। এতে যেমন বর্জ্য নিষ্কাশন সঠিকভাবে হয়ে উঠছে না ঠিক তেমনি পরিবেশের উপরও ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে দিনকে দিন। যেহেতু একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা বা নিষ্কাশন করতে পারা। সাধারণত মেডিকেল বর্জ্য বলতে আমরা বুঝি ব্যবহৃত সুঁচ, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ, ব্যবহৃত মাস্ক, পিপিই (পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট), খালি বা অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া ওষুধের বোতল, রক্তমাখা পস্নাস্টিকের সামগ্রীসহ আরও বেশ কিছু উপাদান যা ব্যবহারের পর বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর উপাদানে পরিণত হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেশিরভাগ সময় ডিসপোজিবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসাসামগ্রী ব্যবহৃত হয়। যার ফলে প্রতিদিন একটি উলস্নখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে মেডিকেল বর্জ্য। আর এগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার অভাবে সংক্রামক রোগব্যাধি বেড়ে যাচ্ছে। দেশের শহরগুলোর হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মেডিকেল বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা মোটেও সুবিধাজনক নয়। এমনকি মাঝেমধ্যে দেখা যায় মেডিকেল বর্জ্য যেমন- রক্ত, পুঁজ মিশ্রিত তুলা, ব্যান্ডেজ, রক্তের ব্যাগ এসব ডাস্টবিনে ফেলে রাখা অবস্থায়। গবেষণায় পাওয়া হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয় শুধু এই মেডিকেল বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে বাংলাদেশের কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই বর্তমানে মেডিকেল বর্জ্যের সুষ্ঠু নিষ্কাশনের মানসম্মত কোনো ব্যবস্থাই নেই। ২০০৮ সালে মেডিকেল বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হলেও সে আইন দুর্বল হওয়ায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে করোনাকালে মেডিকেল বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থায় অনিয়ম দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। কারণ মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। কারণ কোভিড-১৯ এর এই সময়টাতে জনসাধারণের মাস্ক, গস্নাভস, পিপিইসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যবহারের পর এদের নিষ্কাশনের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে এই সামগ্রীগুলো। বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল এবং ৫ হাজার ৫৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। মোট শয্যা সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১.৬৩ থেকে ১.৯৯ কেজি মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কোভিডের সময়ে এই পরিমাণ আরও বেড়েছে। কারণ ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী শুধু রাজধানীতে কোভিডের কারণে ২০৬ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ৬.৬ ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়ে থাকে। বাকি ৯৩.৪ ভাগের কোনো সঠিক ব্যবস্থাপনা হয় না। রাজধানীসহ সারাদেশে মেডিকেল বর্জ্য এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (ইএসডিও), ২০২০ সালের জুন মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের মে মাসে শুধু রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রায় ২৫০ টন মেডিকেল বর্জ্য সংগৃহীত হয়েছে। কিন্তু করোনাকালে এর পরিমাণ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভ মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা এবং তারপর তা উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলার নিয়ম থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল বা ক্লিনিক সে নিয়ম মেনে চলে। বেশির ভাগ হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই এ নিয়মগুলো মোটেও মেনে চলা হয় না। তবে জনসাধারণের একটি বড় অংশই কোনো ধরনের নিয়ম মেনে চলে না। তারা মাস্ক ব্যবহার করে এবং যেখানে-সেখানে ফেলে দেয়। শুধু মাস্ক নয়, হ্যান্ড গস্নাভস, স্যানিটাইজারগুলোও ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো পরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণায় আরও প্রকাশিত হয়, করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ যেসব সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে তার থেকে প্রতিদিন ২৮২.৪৫ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয় যার পুরোটাই অপসারিত হয় গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের থেকে শহরাঞ্চলগুলোতে এসব সুরক্ষাসামগ্রীর হার বেশি; কিন্তু যারা এসব ব্যবহার করে, এসব সুরক্ষাসামগ্রী নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্ঞান না থাকায় তারা এসব অপসারণ করে ফেলে গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে। মেডিকেল বর্জ্যসহ আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত চা, কফি, মুদি দোকানের পলিথিন এসব ব্যবহার করা হয় যা ৫০ বছর পর্যন্ত নষ্ট হয় না। পরিবেশে থেকে যায়। যার ফলে আমাদের পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ওপর। আর এসব পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন প্রাণিকুলের ওপর দেখা যায়। বিভিন্ন প্রাণী বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে ভুগতে থাকে। যেমন- শ্বাসকষ্ট, হার্ট অ্যাটাক, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, ক্যানসার ইত্যাদি। মেডিকেল বর্জ্য আমাদের ভূমি ক্ষয়ের জন্য ও প্রত্যক্ষভাবে অনেকাংশে দায়ী। জমির উর্বরতা কমে যায় এসব বর্জ্য মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার দরুণ। যা থেকে পরবর্তীতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য সঠিক নিয়ম-কানুন, নীতিমালা বাস্তবায়ন করার উপযুক্ত সময় এখনি। কারণ এই মেডিকেল বর্জ্যের ভয়াবহতায় জনজীবন হুমকির সম্মুখীন। তাই হাসপাতালগুলোর মেডিকেল বর্জ্যগুলো সঠিক নির্দেশনা মেনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সাধারণ মানুষ যারা মাস্ক, হ্যান্ড গস্নাভস, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, তারা এগুলো যেখানে-সেখানে না ফেলে কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে বেশ কিছুদিনের ব্যবহৃত বর্জ্য একত্রিত করে পুড়িয়ে ফেলবে। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা দরকার। সরকার কর্তৃক এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে জনগণকে সচেতন করে তুলতে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কালার কোড অনুযায়ী ময়লা উৎপাদন স্থল আলাদা করতে হবে। বর্জ্য খোলা অবস্থায় পরিবহণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এগুলোর শ্রেণিভেদে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আমরা অনেক সময়ই এমন অনেক সংবাদ পেয়ে থাকি যে কিছু অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী বা চক্র এসব ডিসপোজিবল বর্জ্য যেমন সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ, এসব ডাম্পিং স্টেশন থেকে তুলে নিয়ে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে বাজারে ছেড়ে দেয়। পরে যারা এসব ব্যবহার করে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এসব থেকে সচেতন থাকতে হবে। যদি হাসপাতালের বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করা যায় তবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে খুব দ্রম্নত। ফলে আমরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবো। এছাড়া ২০০৮ সালের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশন সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন খুবই প্রয়োজন। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। প্রতিটি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে মেডিকেল ইনসিনেরেটর এবং অটোক্লেভসহ আধুনিক সব ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য বাজেটে সব হাসপাতালের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অবশ্যই মেনে চলতে হবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, 'মাস্ক, হ্যান্ড গস্নাভসসহ যে কোনো ধরনের মেডিকেল বর্জ্য বাইরে ফেলে রাখা উচিত নয়। সরকারি-বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠানই হোক, তাদের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে গাইডলাইনস আছে সেগুলো অনুসরণ করে কাজ করা উচিত। করোনার এই সময় যেভাবে মাস্ক, হ্যান্ড গস্নাভস যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে তাতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যত্রতত্র ফেলা এসব বর্জ্য থেকে সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াবে। কাক মুখে নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ফেলবে, সেখান থেকে ছড়াবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভস মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে তা বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখা। পরে এসব বর্জ্য উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এসব গাইডলাইনস সঠিকভাবে মেনে চলা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা আনয়নের মাধ্যমে আমরা মেডিকেল বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারি এবং পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে পারি। সর্বোপরি নিয়ম-কানুন মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের এবং জনসাধারণের সচেতনতাই পারে এই কঠিন সময়ে কিছুটা হলেও নিজেদের এবং অন্যকে মারাত্মক ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করতে। তাই নিজেও সচেতন হই এবং অন্যকেও সচেতন করি।