শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা

এটা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর দূষণের শিকার।
গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল
  ৩১ জুলাই ২০২১, ০০:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সহকর্মীকে ফেসবুকে আজ সকাল থেকে 'চড়ঢ়ঁষধৎ ঘড়'ি দেখাচ্ছিল। পপুলার হওয়ার মতো কর্মই তিনি করেছেন বটে। গত ২২ জুলাই বিকালে তিনি ভগবানকে মদ্যপ সাজিয়ে ফেসবুকে একটি অনুগল্প লেখেন। ভগবান পৃথিবীতে এসে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে এক দুধ বিক্রেতাকে অভিশাপ দিচ্ছেন- ইত্যাদি তার গল্পের কাহিনি। বলা বাহুল্য, অসংখ্য মানুষ এই পোস্টে নানাভাবে রিয়্যাক্ট করেছেন। শত শত মানুষ কমেন্ট করে তাদের মতামত জানিয়েছেন এবং বহু মানুষ পোস্টটি তাদের টাইমলাইনে শেয়ার করেছেন। এই সুবাদে আমার ফেসবুক বন্ধু না হাওয়া সত্ত্বেও ওই অধ্যাপকের 'অতি সৃজনশীল' অনুগল্পটি আজ সকালে আমার নজরে আসে। এত মানুষ যখন তাকে নিয়ে কথা বলছেন, তিনি তো পপুলার হবেন-ই। আমার ধারণা, লেখক বিষয়টিকে রীতিমতো এনজয় করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো এ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ- নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও বিদ্বজ্জন এখনো এই দাবিকে স্বীকার করেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক, গ্র্যাজুয়েট, অভিভাবকসহ দেশের আপামর জনসাধারণের মনে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গর্বের নাম। দেশের মানুষ এখনো এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি কিছু কিছু শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রদর্শন করেন। কিন্তু আজ ওই শিক্ষকের প্রতি সারাদেশের মানুষ যে ভাষায় অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, তা দেখে আমার অন্যান্য সম্মানিত সহকর্মীদের নিশ্চিত বলতে ইচ্ছা করবে 'ধরণী দ্বিধা হও'।

এটা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর দূষণের শিকার।

সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর মুখে বহুদিন থেকে 'শতকরা নব্বই (কখনো পঁচানব্বই) ভাগ মুসলমানের দেশে' শব্দবন্ধটি প্রায় অনুসিদ্ধান্তের মতো উচ্চারিত হচ্ছে। এর মর্মার্থ হলো, এ দেশে মুসলমান যেহেতু সংখ্যায় অনেক বেশি, সুতরাং অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের মানুষের ধর্ম, জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদিতে সমানাধিকারের প্রশ্নে তাদের কোনো বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য হওয়ার নয়। এতদিন আমরা ভাবতাম এগুলো কতিপয় পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রোপাগান্ডা মাত্র। বাংলাদেশের উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিপরীতে এগুলো কিছুসংখ্যক ধান্দাবাজ, সাম্প্রদায়িক ও ইতর প্রকৃতির মানুষের কাজ ইত্যাদি মনে করে যতই আমরা সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করি, বিষয়টি মোটেই সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা অব্যাহত থাকার ফলে বাংলাদেশের সমাজ মানসে ইসলাম ও মুসলমান ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মানুসারীর অস্তিত্ব প্রায় অনুপস্থিত। এককালে যে সব চিন্তা ও আচরণ প্রবল আপত্তিকর বিবেচিত হতো, তা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে হিন্দু বা অন্য কোনো অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কোনো উগ্র প্রচারকের সস্তা বক্তব্যের সঙ্গে কোনো নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'প্রগতিশীল' অধ্যাপকের শব্দচয়নে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিগত বছরগুলোতে ইসলাম অবমাননার ছুতোয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সংখ্যালঘু শিক্ষক-শিক্ষার্থী নানাভাবে অপদস্থ হয়েছেন। শিক্ষকরা বহু ক্ষেত্রে নিগৃহীত হয়ে চাকরি হারিয়েছেন অথবা নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে, এখনো অনেকে জেলে বন্দি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ধর্ম অবমাননার প্রসঙ্গ আনাটাই বাহুল্য। বিগত এক দশকে সারাদেশে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে শুধু ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অজুহাতে! প্রায় প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশ ও সরকারি প্রশাসন অতি সক্রিয় হয়ে 'আশু' বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। প্রত্যেকটি ঘটনায় পরে প্রমাণিত হয়েছে যে কাউকে পরিকল্পিত উপায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানোর জন্য তার ফেসবুক হ্যাক করে ফটোশপকৃত ছবি বা উস্কানিমূলক বক্তব্য পোস্ট করা হয়েছিল। প্রায় সব ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা কিছু ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার আগেই পুলিশ তথাকথিত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। এসব হামলার ঘটনায় আক্রান্ত ও নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা সাহস করে যদি মামলা করেনও, কিছুদিনের মধ্যে সমস্ত আসামির জামিন হয়ে যায়। জেলে পচে মরেন সেই নির্যাতিত সংখ্যালঘু, যিনি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বলে ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। উল্টোদিকে বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্ম অবমাননার জন্য মামলা হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। সমীকরণ অত্যন্ত সহজ- মামলা যেহেতু হয় না, সুতরাং ধরে নিতে হবে তাদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবমাননার কোনো ঘটনাও ঘটে না। বাংলাদেশের ধর্ম অবমাননার ঘটনা বা মামলা প্রায় একপাক্ষিক। গত এক দশকে ঘটে যাওয়া অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানের প্রায় সমকক্ষ।

এক দশকের বেশি সময় একটানা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, অথচ এই সময়কালেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বিরতিহীনভাবে ঘটেছে। একজন চিত্রনায়িকার ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্তকে রক্ষার জন্য জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হতে পারে, কিন্তু দুই কোটির বেশি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবন ও সম্পদের ওপর ক্রমাগত আঘাত ও নির্যাতন বিষয়ে কেউ কোনো দিন টু শব্দটি করতে সাহস করে না।

তো, ওই অধ্যাপক কি ভুল করে ভগবানকে মদ্যপ বানিয়েছেন? ব্যক্তিজীবনে তিনি তো সৃষ্টিকর্তাকে 'ভগবান' নামে সম্বোধন করেন না, তাহলে তাকে নিয়ে তামাশা করার সময়েই কেন শুধু হিন্দুর ভগবানকে দরকার হয়? তিনি হয়তো ভেবেছেন, অমুসলমানের ভগবান বা ঈশ্বরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। সত্যিই তো! আসলে, এ দেশের জল-হাওয়াই তাকে এমন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তাকে আর আলাদা দোষ দিই কী করে?

দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের এই মহান অধ্যাপক শেষ পর্যন্ত জানিয়েছেন, তিনি জানতেনই না যে এরকম একটি সাধারণ কথায় কারো ধর্মীয় চেতনা ক্ষুণ্ন্ন হতে পারে। আহা! এই না হলো আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষাগুরু!

গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে