নারী অবমাননা, ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলন ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ

প্রশ্ন হচ্ছেÑ ভারতে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের ফলাফল কী দঁাড়াবে। যারা এসব করে আসছেন তাদের মানসিকতার কি বদল ঘটবে, মন্ত্রিত্ব গেলে, বিচারকের আসন থেকে বাদ পড়লে কিংবা শাস্তি হলে? কেবল বিনোদন জগতে নয়, যেখানে পুরুষ রয়েছে সেখানেই নারী অনিরাপদ। এটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা। এই সমাজ নারীকে চিরকাল সেবাদাসী যৌনদাসী ভোগ্যপণ্য হিসেবেই বিচার ও বিবেচনা করে আসছে। সুতরাং সুযোগ পেলেই যে পুরুষ নারীকে অবমাননা করবে, করবে যৌন নিযার্তন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নারী স্বাধীনতার নামে আমরা যা দেখছি এটা খোলস মাত্র। নারী সম্পকের্ সব পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই। এর প্রধান কারণ নারীকে আমরা কেবল নারীই ভাবি, মানুষ ভাবি না।

প্রকাশ | ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
নারীর অবমাননা বা নিযার্তন পরিবার ও সমাজে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যৌতুকের জন্য, ফতোয়ার শিকার হয়ে, স্বামীর পরকীয়ার কারণে, ধষর্ণ কিংবা গণধষের্ণর শিকার হয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবর-ননদের অত্যাচার-নিযার্তনে এ দেশের অনেক অসহায় নারীর প্রাণ চলে গেছে, এখনো যাচ্ছে। কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝঁাপ দিয়ে সন্তানসহ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মাহুতি দিয়েছে। নারী নিযার্তন রোধে নারী সংগঠন, নারীবাদীরা এমনকি সরকারও সোচ্চার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু দিল্লিতে চলন্ত বাসে গণধষের্ণর ঘটনার পরপরই আমাদের দেশে একাধিক ঘটনা ঘটে। মানিকগঞ্জ, সাভার, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও বরিশালে চলন্ত বাসে এবং সিএনজিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া শিশু ধষের্ণর ঘটনা ঘটে বেশ কয়েকটি। ভারতের সবর্স্তরের মানুষ যেমন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের এখানে সেটা চোখে পড়েনি। এর প্রধান কারণ এ ব্যাপারে আমরা ততটা সচেতন নই। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ নয়, একপেশে। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েই পরিবার ও সমাজের জন্য অনিবাযর্। পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন নারী-পুুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ, পরিকল্পনা, ত্যাগ ও সংযমের প্রয়োজন। একইভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষার স্বাথের্ নতুন সমাজ বিনিমাের্ণর জন্য উভয়েরই ভ‚মিকা ও অবদান সমভাবে প্রয়োজন। সে জন্য একজনকে উপেক্ষা করে বা বাদ দিয়ে কেবল পুরুষ কিংবা নারীর পক্ষে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। তাই আমরা চাই নারী-পুরুষের সৌহাদর্পূণর্ সমঝোতামূলক সম্পকর্, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পকর্। কিন্তু আমাদের এ চাওয়ার সফল বাস্তবায়ন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কোথাও চোখে পড়ছে না। বরং প্রতিনিয়ত উল্টো ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে। পান থেকে চুন খসলেই আমরা নারীকে অপবাদ দিই। কথায় কথায় নারীকে কুলটা চরিত্রহীন ব্যভিচারী বলে আখ্যা দিই। নারীর দোষের অন্ত নেই। অন্যদিকে পুরুষরা শত অপরাধ করলেও তাদের চরিত্রে কোনো ধরনের কালিমা লিপ্ত হয় না। ভাবটা এমন যে পুরুষের ‘চরিত্র’ বলে কিছু নেই। এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিগত জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নারীর নয় কেবলই পুরুষের। এটা যতদিন থাকবে ততদিন নারীর মুক্তি নেই, নারী স্বাধীনতার কথা বলে আমরা মুখে যতই ফেনা তুলি না কেন। সম্প্রতি ভারতে হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যাচ্ছেন অনেক নামিদামি ব্যক্তি। একে একে উঠে আসছে যৌন নিযার্তন বা নারী অবমাননার কাহিনী। ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও রাজনীতিক মোবাশার জাবেদ আকবর (এম জে আকবর) নারী নিযার্তনের অপবাদ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। স্বাধীন ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে কখনো পদত্যাগ করতে হয়নি নারী অবমাননার কারণে। তবে রেল দুঘর্টনার নৈতিক দায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও মাধব রাও সিন্ধিয়ারা। এটা ভারতের আলোচিত ঘটনা। অবশ্য বাংলাদেশে এ ধরনের পদত্যাগ সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেকেই বলছেন এম জে আকবরের পদত্যাগ বাংলাদেশে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভালো ফল বয়ে আনবে না। কারণ তার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে জানা, বাঙালির আবেগ ও মানসিকতাকে বোঝার ক্ষমতা ছিল বলেই বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছাকাছি অনেক দ্রæত তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন। এটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে উঠে এসেছে তার নৈতিক স্খলনের বিষয়টি। এম জে আকবরের পদত্যাগের পর এবার বিচারকের পদ হারালেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী আনু মালিক। যৌন হেনস্তার ঘটনায় একের পর এক অভিযোগে আক্রান্ত এই শিল্পী। এবার ইন্ডিয়ান আইডল-১০ এর বিচারকের আসন থেকে সরে যেতে হলো তাকে। উল্লেখ্য, বলিউড অভিনেতা নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত। এরপর থেকে একের পর এক থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন এখনো পযর্ন্ত সমাজের উচ্চবগীর্য় ও সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সমাজের অন্য স্তরে এই ঢেউয়ের পৌঁছে যাওয়াটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ভারতের বিনোদন জগতে একের পর এক যে অভিযোগ আসছে তা এত বছর পর কেন? এটা ঘটনা ঘটার পর পরই তো হতে পারত। প্রশ্ন হচ্ছেÑ ভারতে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের ফলাফল কী দঁাড়াবে। যারা এসব করে আসছেন তাদের মানসিকতার কি বদল ঘটবে, মন্ত্রিত্ব গেলে, বিচারকের আসন থেকে বাদ পড়লে কিংবা শাস্তি হলে? কেবল বিনোদন জগতে নয়, যেখানে পুরুষ রয়েছে সেখানেই নারী অনিরাপদ। এটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা। এই সমাজ নারীকে চিরকাল সেবাদাসী যৌনদাসী ভোগ্যপণ্য হিসেবেই বিচার ও বিবেচনা করে আসছে। সুতরাং সুযোগ পেলেই যে পুরুষ নারীকে অবমাননা করবে, করবে যৌন নিযার্তন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নারী স্বাধীনতার নামে আমরা যা দেখছি এটা খোলস মাত্র। নারী সম্পকের্ সব পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই। এর প্রধান কারণ নারীকে আমরা কেবল নারীই ভাবি, মানুষ ভাবি না। নারী অবমাননা কিংবা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর সমাধানে কেবল আইন করলেই চলবে না, সবাইকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। নারী নিযার্তন বন্ধে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও কমর্সংস্থানের দরকার। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্র সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আশার বিষয় হলোÑ বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অধেের্করও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী সবাই নারী। এমনকি স্পিকারও নারী। তৈরি পোশাক খাতের ৮০ ভাগ শ্রমিকই এখন নারী। বাংলাদেশের নারীদের সমান অধিকার দিয়েছে সংবিধান। সেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মযার্দার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আন্তজাির্তক আইনগুলোতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। নারীরা যেন সুবিচার পান, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে। তবে সংবিধান নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দিলেও অশিক্ষা, দারিদ্র্য বাংলাদেশের নারীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। এ দেশের সহিংসতার শিকার একটি মেয়েকে থানার পুলিশ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সংকট মোকাবেলা করতে হয়। পদে পদে সবাই বোঝানোর চেষ্টা করে যেন মেয়েটাই দায়ী। নারী অবমাননা কিংবা যৌন নিযার্তনের ক্ষেত্রে মেয়েটিকে কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ নেই। নারীর সবচেয়ে গøানিময় অপমানসূচক অধ্যায় হচ্ছে যৌন নিযার্তনের শিকার হওয়া। এ দেশের নারীরা যৌন নিযার্তনের শিকার নানাভাবে হতে পারে। তবে এর দুটো দিক রয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে যৌন নিযার্তন। যে নারীর শরীর যত আকষর্ণীয় ও লোভনীয় তার নিযার্তন ঝুঁকি তত বেশি। এ ধরনের নারী যখন রাস্তায় চলে তখন বখাটে ছেলেরা শরীরকে লক্ষ্য করে বাজে ইঙ্গিত করে। সুযোগ পেলে তাকে নিযার্তন ধষর্ণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নারীও যে মানুষ এটা তারা মুহূতের্ ভুলে যায়। এ ধরনের নিযার্তন ইদানীং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ও কমের্ক্ষত্রেও হচ্ছে। এমনকি শিক্ষকরাও এ ধরনের অপকমের্ জড়িয়ে পড়ছেন, অবতীণর্ হচ্ছেন ধষর্ণকারীর ভ‚মিকায়। কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তি মানে ও বোঝে। মানুষের দুঃখ-শোকে কাতর হন যিনি, সহমমির্তা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নারী অবমাননাকারী নিযার্তক বা হত্যাকারীর ভ‚মিকায় অবতীণর্ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিকতা সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নিযার্তন হত্যাকেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। তবে তার আগে প্রয়োজন দেশব্যাপী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো, দারিদ্র্য বিমোচনে ও বেকারত্ব দূরীকরণে কাযর্কর পদক্ষেপ নেয়া। সবকিছু যদি সঠিক ও সমান্তরালভাবে চলে তবে সমাজ ও রাষ্ট্রও সঠিকভাবে চলবে। আর প্রতিদিন পারিবারিক ও সামাজিক নিযার্তনের ভয়াবহতা আমাদের প্রত্যক্ষ করা লাগবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা। এটা যতদিন না হবে ততদিন পযর্ন্ত নারী নিযার্তনের মাত্রা ও ভয়াবহতা কমবে না। আর এর জন্য আন্তজাির্তক নারী দিবস পালন করে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, প্রতিবাদ সভা-পথসভার মাধ্যমে চিৎকার করেও কোনো ফল হবে না। নারী তো তার সামগ্রিকতা নিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। কিন্তু পুরুষকে তো তা গ্রহণ করার মানসিকতা, সাহস ও উদারতা অজর্ন করতে হবে, হতে হবে উন্নত সাংস্কৃতিক ও রুচির অধিকারী। দায়িত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও এককভাবে পুরুষের। এ ব্যাপারে নারীরও করণীয় কম নয়। কারণ যিশুর ক্রুস যিশুকেই বহন করতে হয়েছে। স্বামী, অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজনদের নারীর কতর্ব্য কাজে উৎসাহ জোগাতে হবে। তাদের সফল উদ্যোগ ও চিন্তাকে স্বাগত জানিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। চরম বেকারত্বের এ দেশে, ঋণনিভর্র অথৈর্নতিক ভিতের ওপর দঁাড়ানো বাংলাদেশে, অতি উচ্চমূল্যের বাজারে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নারী স্বাধীনতা খেঁাজা অথর্হীন। তবে চেষ্টা চালাতে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দোষ কী। দিন না বাড়িয়ে সেই হাত। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবতর্ন এবং নারী অথৈর্নতিক স্বাবলম্বিতা অজর্ন করলে কিছুটা পরিবতর্ন সূচিত হতে পারে, সে জন্য আমাদের নারীদের আরও দীঘর্ পিচ্ছিল ও ঝুঁকিপূণর্ পথ পাড়ি দিতে হবে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক