মহান শিক্ষা দিবস ও কিছু কথা

শিক্ষা দিবসের মতো আমাদের এত বড় একটি ঐতিহাসিক অর্জন থাকলেও নতুন প্রজন্ম এটির সঙ্গে পরিচিত নয়।

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

আব্দুর রউফ
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর। ঐতিহাসিক মহান শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের আজকের এই দিনে এ দেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মোস্তফা ওয়াজিলস্নাহ, বাবুলসহ আরও অনেকেই। সেদিন ঢাকার রাজপথে অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শিক্ষার অধিকার হনন করার কৌশল রুখে দেওয়া। এ দেশের ছাত্র-জনতা সেদিন সেই অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল নিজেদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। সেদিন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শরিফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতিকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। কথায় আছে- যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যেটি আন্দাজ করতে পেরেছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন পাকিস্তানের সদ্য সামরিক জান্তা সরকার আইয়ুব খান। যেটি ঐতিহাসিকভাবে শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। সেই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। যে শিক্ষানীতির বেশ কিছু সুপারিশ তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে একদম প্রাসঙ্গিক ছিল না। ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তথা ১৯৭৪ থেকে ১৯৭১ সালের এই সময়টুকুতে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসন ব্যবস্থায় নানা ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে অন্যতম এই শিক্ষা আন্দোলন। যে আন্দোলনের সুফল কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে আজকে আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষানীতি পরিহার করে এ দেশের মানুষ যে সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তৎকালীন শরীফ শিক্ষা কমিশন যে সুপারিশগুলো প্রকাশ করেছিল তাতে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি ও উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক সীমাবদ্ধতা ও শর্তারোপ করা হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শরীফ কমিশনের এই শিক্ষা সংকোচন নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তৎকালীন অনেকেই বলেছেন, যেন এই বঙ্গের মানুষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে না পারে তার সব ব্যবস্থা ছিল এই প্রস্তাবনায়। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল ডিগ্রি কোর্স দুই বছর থেকে তিন বছর করা, কলেজপর্যায়ে বছর শেষে পরীক্ষা ও তার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী বর্ষে উন্নীত হওয়ার শর্ত, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের নির্ভর করা। এই শর্তগুলোকে ছাত্র-জনতা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ বন্ধ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। এই প্রতিবেদনটি ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়। সামরিক আইন জারি থাকার কারণে দেশে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই আন্দোলন তেমন বেগবান করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এই প্রস্তাবনায় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। আইয়ুব খান ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে। যেন কোনো শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে না পারে। তবে ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয় রিপোর্ট বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলনের শুরু থেকেই আইয়ুব খান সরকার ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন করতে থাকে। নানা চড়াই-উতরাই পার করে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৪৪ ধারা উপেক্ষিত করে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। সেদিন পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল সামনের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশ নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করে। এতে অনেকেই আহত ও নিহত হলে আন্দোলনের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। যার ফলে আইয়ুব খান সরকার এই শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। নিঃসন্দেহে ইতিহাসে ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন গুরুত্ব বহন করে। এই শিক্ষা আন্দোলন ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবেও ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। যে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট পরবর্তীতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। যে কারণেই আইয়ুব খান সরকারের পতন হয়েছিল। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের নিরঙ্কুশ জয় সম্ভব হয়েছিল। পরে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে গোটা পূর্ববাংলার জনতাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে ৬২'র শিক্ষা আন্দোলনকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসে শিক্ষা আন্দোলন বাঁক ফেরানোর মতো ঘটনা। সময়ের পরিক্রমায় এই আন্দোলন শুধু শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল আন্দোলনের সীমাবদ্ধ ছিল না। পর্যাক্রমে ছাত্রনেতারা খাজনা বৃদ্ধিসহ গ্রেপ্তারকৃত অসংখ্য নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি করেছিল। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীরা এক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকেনি। বরং এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সামরিক সরকারবিরোধী চেতনাকে আরও বেগবান করে তোলে। যে কারণে এক সময়ে সামরিক সরকার আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ৬২'র শিক্ষা আন্দোলনের প্রায় ৫৯ বছর হতে চলল। ইতিমধ্যেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপন করছে। অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সামাজিক ভাঙা-গড়া, অর্থনৈতিক তারতম্য নানা রকম প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যদিয়ে দেশ ও জাতি এগিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছর সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শিক্ষায় সবার অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এসেছে। তবে তা এখনো মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটে বেসরকারি শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ করারোপ এমনটি প্রমাণ করে। শুধু বেসরকারি নয়- সরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে প্রতি বছরই ফি বৃদ্ধি করা হয়। দেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির নামে ভর্তি ফিসহ আনুষাঙ্গিক ফিগুলো প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। যেন টাকা যার শিক্ষা তার সেই নীতির পথেই হাঁটছে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- শিক্ষাকে সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া। বর্তমান বাংলাদেশের সংবিধানের শিক্ষাকে মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও বাম ছাত্র সংগঠন শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। শিক্ষা দিবসের মতো আমাদের এত বড় একটি ঐতিহাসিক অর্জন থাকলেও নতুন প্রজন্ম এটির সঙ্গে পরিচিত নয়। \হশিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন, সেদিন যদি ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত না হতো তাহলে আমরা হারাতাম আমাদের শিক্ষার অধিকার। হয়তো আমরা ভুলে যেতাম আমাদের কৃষ্টি-কালচার ও মাতৃভাষা। নতুন প্রজন্মের নিকট এই ঐতিহাসিক অর্জনগুলোর সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দিতে হবে। যদি ১৭ সেপ্টেম্বরকে সরকারিভাবে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই শিক্ষা দিবস সম্পর্কে জানতে পারবে। তাই এই শিক্ষা দিবসে বাংলাদেশ সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি প্রত্যাশা থাকবে ১৭ সেপ্টেম্বরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সব শহীদদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। আব্দুর রউফ : কলাম লেখক