কিশোর অপরাধ ও আত্মহত্যা রোধে পরিবারকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে মানুষ একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়াও আত্মহত্যার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মে শিশুরা বেশি সময় ব্যয় করছে। এ কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে তাদের চোখ, মাথা ও কানের মতো পঞ্চইন্দ্রিয়ের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়ছে। এতে তারা সংবেদনশীল হতে বাধ্য। মূলত প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতে না পারা মানুষকে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। একজন মানুষের জীবনে একের পর এক এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে চরম মাত্রায় হতাশ করে তোলে। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এটাই হয়ে আসছে।

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন পশ্চিমা বিশ্বে বেশ অনেক বছর আগে যে গ্যাং কালচারের সূত্রপাত তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নতুন এ সংস্কৃতির। এ কিশোররা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। এ সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ সবকিছু আলাদা। এ সমাজের যারা সদস্য তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। পেশিশক্তি দেখিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা, দলে-বলে চলা এদের বৈশিষ্ট্য। দেশজুড়ে নগরকেন্দ্রিক গ্যাং কালচার ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। মাদক নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ইভ টিজিং, মাদক ব্যবসা, এমনকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বা অন্য গ্যাং গ্রম্নপের সঙ্গে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুনখারাবি থেকেও পিছপা হচ্ছে না কিশোর অপরাধীরা। আরও উদ্বেগের বিষয়- মাদক নেশার টাকা জোগাড়ে ছোটখাটো অপরাধে জড়ানো বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। এর পেছনের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক বড় ভাইদের স্বার্থের প্রশ্রয়। পড়াশোনা থেকে ঝরেপড়া এসব কিশোর স্কুল-কলেজের মোড়ে দল বেঁধে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা থেকে মাদক সেবন, চুরি, ছিনতাই এবং খুনের মতো অপরাধও করে থাকে নির্দ্বিধায়। ছোট-বড় কাউকেই করে না সমীহ। পারিবারিক অনুশাসন না থাকায় তারা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। পুলিশসূত্র বলছেন, রাজধানীতে প্রতি মাসে হত্যার ঘটনা ঘটে গড়ে ২০টি। এর বেশির ভাগ ঘটনায় কিশোর অপরাধীরা জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। সামাজিক যে অনুশাসনগুলো ছিল এগুলো সমাজে কাজ করছে না। যেমন- সমাজের ভিতর পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা, বন্ডিং- এগুলো নষ্ট হয়ে ছন্দপতন ঘটছে। এসব কারণে কিশোর-তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর অপরাধ রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি পরিবারকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। এদিকে করোনা মহামারিতে হঠাৎ করেই বেড়েছে আত্মহত্যা। করোনায় মৃতু্যর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে আত্মহত্যায় মৃতু্যর সংখ্যা। খোদ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) জরিপে উঠে এসেছে এমন চিত্র। দেখা গেছে, শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সি এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সি মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা। সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, বস্ন্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে। এর বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। করোনাকালে বাংলাদেশের ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মানসিক চাপ আগের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের মানসিক অস্থিরতায় ভোগে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী শারীরিকভাবে নিজের ক্ষতি করছেন। মানসিক বিভিন্ন চাপের ফলে অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা গেছে। এ সময় ৫০ দশমিক ১ শতাংশই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের 'আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা' শীর্ষক নতুন এক জরিপে এমনটি উঠে এসেছে। করোনাকালে এত বেশিসংখ্যক তরুণের আত্মহত্যার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগের। মূলত তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণ চিহ্নিত করা এবং তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্যই এ জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। ৩২২টি আত্মহত্যার কেস স্টাডি করে দেখা যায়, যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ৪৯ শতাংশেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আর এদের ৫৭ শতাংশই নারী। জানা যায়, ২০২১ সালে ১ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে মোট ২০২৬ জন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জরিপে সবচেয়ে বেশি অংশ নেন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সি মোট ১৭২০ জন তরুণ-তরুণী। যা মোট জরিপের ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। আর জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশই অবিবাহিত। এদের মধ্যে অধিকাংশই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এছাড়া অন্যান্য পেশার মানুষের মধ্যে ৭ দশমিক ১ শতাংশ চাকরিজীবী, শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ব্যবসায়ী, বেকার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তাসহ অন্য পেশাজীবী ছিলেন ২ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্যে, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে কিন্তু তারা তা চেষ্টা করেননি। ৮ দশমিক ৩ শতাংশ আত্মহত্যার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম প্রস্তুত করলেও তা করতে পারেননি। ৩ দশমিক ৭ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। তথ্যানুযায়ী, তরুণদের মধ্যে অধিকাংশই মানসিক বিষণ্নতায় ভোগেন। যেমন- অধিকাংশ সময় মন খারাপ থাকা, পছন্দের কাজ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক কম বা বেশি ঘুম হওয়া, কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা, সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা। এ সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তরুণরা। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ১২৩৯ জনই (৬১.২%) বলেছেন, তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন। আর ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ জানান, তাদের মানসিক অস্থিরতার বিষয়ে কারও সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে পারেন না। মন খারাপ হলে বা বিষণ্ন হলে তরুণ-তরুণীদের ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ বন্ধুদের সঙ্গে, ২২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের সঙ্গে এবং ১ দশমিক ৯ শতাংশ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা শেয়ার করেন। তবে জরিপে অংশগ্রহণকারী বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে কেউই তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে বিষণ্নতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন না। এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ৭৬ দশমিক ১ শতাংশের পরিমিত ঘুম হলেও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশের পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। এছাড়া এই তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশই দৈনিক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন যা মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে তুলছে। জরিপে দেখা যায়, ২৮ শতাংশই দৈনিক ৬ ঘণ্টার বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন। ২৬ শতাংশ দৈনিক ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা এবং ৩১ শতাংশ দৈনিক ২ থেকে ৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯৪ শতাংশই বলছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য তাদের দৈনন্দিন কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। দুঃখজনক হলেও এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু ৯১ দশমিক ৪ শতাংশই কখনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেননি। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে মানুষ একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়াও আত্মহত্যার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মে শিশুরা বেশি সময় ব্যয় করছে। এ কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে তাদের চোখ, মাথা ও কানের মতো পঞ্চইন্দ্রিয়ের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়ছে। এতে তারা সংবেদনশীল হতে বাধ্য। মূলত প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতে না পারা মানুষকে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। একজন মানুষের জীবনে একের পর এক এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে চরম মাত্রায় হতাশ করে তোলে। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এটাই হয়ে আসছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পালস্না দিয়ে সমাজ নানা জটিল বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধগুলো ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আরও বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েদের জন্য তৈরি করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার বলয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই নানা সংকটের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরি করে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে। কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না হলে বিষণ্নতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়। আর কে চৌধুরী :মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ