বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কম্পোস্টিং

বর্তমান সময়ে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। সেইসঙ্গে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দরুন জমিতে বিরূপ প্রভাবও দেখা যায় এবং পাশাপাশি জমিতে জৈব পদার্থ ও উপকারী অনুজীবের পরিমাণ হ্রাস পায়।
মো. জাহাঙ্গীর আলম
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

বাংলাদেশ জনসংখ্যায় বিশ্বে অষ্টম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর প্রতিবেদন-২০১৯ সালের উপাত্ত অনুযায়ী এ জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৭ লাখ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৩%। এখানে শহরাঞ্চলে ২০১০-১৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩%। ভাবনার বিষয় হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরাঞ্চলে মানবসৃষ্ট বর্জ্য তৈরি হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহার বা ভোগ করার পর অব্যবহারযোগ্য যে আবর্জনা তৈরি হয় সেগুলোকে বর্জ্য পদার্থ বলে। বর্জ্য সাধারণত কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, বিষাক্ত ও বিষহীন- এই পাঁচ প্রকারের হয়ে থাকে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সমস্ত জীবকূলকে রোগের হাত থেকে রক্ষা, পরিবেশ দূষণ ও অবনমন রোধের উদ্দেশ্যে আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনঃব্যবহার এবং নিষ্কাশনের সমন্বিত প্রক্রিয়াকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলা হয়। সাধারণত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় বর্জ্য বস্তুর উৎপাদন কমানো। সমন্বিত এবং সম্পূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনটি নীতি প্রয়োগ করা হয়। তিনটি নীতি হলো- জবফঁপব (কমানো), জব-ঁংব (পুনর্ব্যবহার) এবং জবপুপষব (পুনশ্চক্রীকরণ)। আর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কম্পোস্টিং একটি খুবই কার্যকরী পদ্ধতি।

দৈনন্দিন জীবনে বর্জ্য ভেবে যা আমরা ফেলে দেই, তাতেই জন্মাতে পারে রোজকার খাওয়ার আনাজপাতি। তার জন্য প্রয়োজন শুধু একটু সময় ও যত্ন। প্রত্যেক দিন আনাজপাতির খোসা, ডিমের খোসা ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে সেগুলো একটি পাত্রে জমিয়ে তৈরি করা যায় কম্পোস্টিং। এটি একটি অ্যারোবিক, বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা জৈব পদার্থের বিচ্ছেদের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া- যার ফলে খাদ্য ও বাগানের জৈব বর্জ্য, মাটি উপাদানে পরিণত হয়- যা কম্পোস্ট বলা হয়। কম্পোস্টিংয়ের জন্য মূল উপাদান হলো, যে কোনো রকমের জৈব বর্জ্য। আনাজপাতির খোসা থেকে গাছের পাতা, গোবর, কচুরিপানা দিয়েও কম্পোস্ট করা যায়। একে জৈব পদ্ধতিও বলা যায়। কারণ এ পদ্ধতিতে আনাজপাতির খোসা, গাছের পাতা, জীবজন্তুর বিষ্ঠা ইত্যাদি জৈব বর্জ্য ডিকম্পোজ করা হয় যেখানে হিউমাসের মতো একটি উপাদান তৈরি হয়- যা মাটিকে পুষ্টি জোগায়; যেটি গাছের জন্য ভালো সারও বলা যায়। অনেক সময় দেখা যায় যে, একই মাটিতে একাধিকবার চাষের পরে সেই মাটির পুষ্টিগুণ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন এই কম্পোস্ট ব্যবস্থাপনা করে মাটিতে পুষ্টির জোগান ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য প্রথমেই সাধারণত মাটির মধ্যে একটা বড় চৌবাচ্চা বানিয়ে তার মধ্যে আনাজপাতি ও ডিমের খোসা, লতা-পাতা এনে জড়ো করে সেখানে গোবর নিয়ে কেঁচো ছেড়ে দেয়া হয় এবং উপরে মাটি চাপা দিয়ে ঢেকে দিয়ে রাখার কয়েক মাসেই তৈরি করা যায় প্রাকৃতিকভাবে কম্পোস্টিং। কম্পোস্টিংয়ের ফলে ভালো জৈব সার তৈরি করা যায়- যা দারুণ গুণসম্পন্ন হয় এবং এতে রাসায়নিক মেশানো হয় না বলে ফসলের বা মাটির ক্ষতিও হয় না। কম্পোস্টিং অনেক পদ্ধতিতে করা যায়- যেমন অ্যারোবিক, অ্যানঅ্যারোবিক ও ভার্মি-কমপোস্টিং।

কম্পোস্ট শুরু করার আগে আনাজপাতির খোসা থেকে শুরু করে চায়ের পাতা, কাঠের গুঁড়ো, নিজের বাড়ির বাগানের ঝরে যাওয়া পাতা ইত্যাদি জমা করা হয়। এক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত গাছের পাতা ব্যবহার করা উচিত নয়। বাড়িতে বাগান বা আলাদা কম্পোস্টিংয়ের জায়গা না থাকলে ঢেকে দেওয়া একটি পাত্র ব্যবহার করতে হয়। অ্যারোবিক কম্পোস্টিং পদ্ধতিতে বাতাসের অক্সিজেন ও মাটির মাইক্রোবস, উচ্চ তাপমাত্রায় জৈব পদার্থ ভেঙে ডিকম্পোজ করাতে সাহায্য করে, তাই এই ধরনের কম্পোস্টে বায়ুসঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। টাম্বল স্টাইলের কম্পোস্টার ব্যবহারও করা যায়। তবে এতে প্রত্যেক দিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কম্পোস্টারের ভেতরে বায়ু প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং আর্দ্রতা বজায় রাখতেও জল দিতে হয়। দুর্গন্ধ এড়াতে মাঝেমাঝে ঢাকনা খুলে উল্টেপাল্টে দিতে হয়। এই ধরনের কম্পোস্টিংয়ে গাছের পাতাও ব্যবহার করা হয়। অ্যারোবিক কম্পোস্টিং অনেকভাবেই করা যায়। যেমন, উইন্ডরো, স্ট্যাটিক পাইল, ইন-ভেসেল কম্পোস্টিং। অপরদিকে অ্যানঅ্যারোবিক কম্পোস্টিং পদ্ধতিতে অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়াই বর্জ্যের পচন সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে বর্জ্যের পচন ত্বরান্বিত করে বিভিন্ন মাইক্রোঅর্গ্যানিজম বা অ্যানঅ্যারোবিক ব্যাকটেরিয়া এবং এতে সময় লাগে অনেক। প্রায় এক বছর কিন্তু পরিশ্রম কম হয়। এই পদ্ধতিতে একটি পাত্রে বর্জ্য জমা করে ঢেকে দিয়ে সেটিকে এক বছর কোথাও রেখে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে যেহেতু কম্পোস্টারে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকে না, তাই ভীষণ গন্ধ হয়। এমনকি মিথেন গ্যাসও তৈরি হতে পারে। এই দুই কম্পোস্টিংয়ের তুলনায় ভার্মি-কম্পোস্ট পদ্ধতি, কম্পোস্টিংয়ের দিক দিয়ে গুণগত মান ভালো ও সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। এই কম্পোস্টিংয়ে মূলত ব্যবহার হয় কেঁচোর। সাধারণত এসিনিয়া ফোটিডা প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও অনেক প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করা যায়। এই ধরনের কেঁচো অনেক জৈব বর্জ্য খায় এবং এরা যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে তা হরমোনস, এনজাইমস ও অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর হয়। ফলে তা যদি মাটিতে দেওয়া হয়, মাটির উর্বরতা বেড়ে যায় বহুগুণে। এই বর্জ্যের সঙ্গে একটু গোবর মিশিয়ে দিলে আরও সেটির গুনাগুন আরো ভালো হয়। যে কোনো অ্যাপার্টমেন্ট অথবা বাড়িতেও ভার্মি-কম্পোস্ট করা যায়। এই পদ্ধতিতে রোজ পরিবার পিছু প্রায় ১ কিলোগ্রাম জৈব বর্জ্য সংগ্রহ করে নিদিষ্ট একটি জায়গায় জমিয়ে রাখতে হয় প্রায় পনেরো দিন। কয়েকদিন পর বর্জ্য খানিকটা পচে-গলে যাওয়ার পরে কনটেনার বেড তৈরি করে দিতে হয়- যা সাধারণত লম্বায় ১৫ ফুট, ৪ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর হয় এবং এই বেডের মধ্যে জমিয়ে রাখা বর্জ্য ট্রান্সফার করে পরবর্তী সময়ে এর মধ্যে ১০ কিলোগ্রাম কেঁচো ছেড়ে দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। মজার ব্যাপার হলো প্রয়োগকৃত কেঁচোই বর্জ্য খেয়ে বিষ্ঠা ত্যাগ করে এবং এরা নিজের ওজনের দু'তিন গুণ বর্জ্য রোজ খেয়ে ফেলে যার দরুন এক মাসেই মাল্টিপস্নাই করে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে এই কম্পোস্টের প্রক্রিয়াটিও দ্রম্নত হয়। এই পদ্ধতিতে কেঁচোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পাত্রে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ভালো হতে হয় এবং মাস দেড়েকের মধ্যে কম্পোস্ট তৈরি হয়ে গেলে সেপারেটর যন্ত্রের মাধ্যমে কেঁচো আলাদা করে নেয়া হয়- যা পরবর্তী সময়ে মাটিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই পদ্ধতিতে উৎপন্ন জৈব সার গাছের জন্য খুবই ভালো ও গুণাগুণ মানসম্পন্ন হয়।

বর্তমান সময়ে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। সেইসঙ্গে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দরুন জমিতে বিরূপ প্রভাবও দেখা যায় এবং পাশাপাশি জমিতে জৈব পদার্থ ও উপকারী অনুজীবের পরিমাণ হ্রাস পায়।

এছাড়াও জমির পুষ্টি উপাদানের মাত্রা ও ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এজন্য জমিতে কম্পোষ্ট ব্যবহার খুবই প্রয়োজন এবং বর্জ্যকে ব্যবহার করে জৈব সার উৎপাদন, বর্জ্য প্রতিরোধ, হ্রাসকরণ ও পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বর্জ্য সমস্যা জ্ঞান না করে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করাই শ্রেয় এবং বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এর ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে - যা একদিকে যেমন বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার করা যাবে, উপরন্তু এই পদ্ধতিতেই কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না করে ভালো ফসলও পাওয়া সম্ভব।

মো. জাহাঙ্গীর আলম : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে