শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়ে বিচ্ছেদ রুখতে দরকার পারস্পরিক ভালোবাসা ও বিশ্বাস

নতুনধারা
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

বর্তমান সময়ের আলোচিত-সমালোচিত বিষয় আর কিছুই নয় বিয়েবিচ্ছেদ। করোনা মহামারির মধ্যে এ যেন নতুন এক মহামারি।বর্তমানে বিয়েকে খেলাঘরে রূপ নিয়েছে, যার অন্ত বিচ্ছেদ ছাড়া আর কিছুই নয়।?বিয়েবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি।

জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় ভাঙছে একটি সংসার। এক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছেন নারীরা, বাকি ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন পুরুষরা। তবে এটা কেবল শহরের হিসাব। তবে পুরো দেশের অবস্থা আরও শোচনীয়।

করোনাকালীন সময়ে যখন পুরুষদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায় তখন সংসারে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়, যার অন্ত হয় বিয়েবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে যখন ব্যক্তিত্বের আঘাত, রুচি ও মনোভাবের পরিবর্তন, আর্থিক সংকট, নিরাপত্তা বোধের অভাব ও নানাবিধ অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হয় তখনই তা বিয়েবিচ্ছেদে রূপ নেয়। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বামীর বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের অভাব, স্ত্রীর বিলাসবহুল জীবনযাপন, যৌতুকের ভার চাপানো, একে অপরের প্রতি নেতিবাচক সন্দেহভাজন প্রবণতা এবং স্বামীর মাদকাসক্তে আসক্ততার ফলে বিয়েবিচ্ছেদ দিন দিন বেড়েই চলছে। এর শেষ কোথায় আমরা নিজেরাই জানি না।

এছাড়া বিয়েবিচ্ছেদের উলেস্নখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল, পরকীয়া, যৌতুক, নারী নির্যাতন, চাকরি সমস্যা, যৌনজীবনে সমস্যা, অপসংস্কৃতি, প্রেমঘটিত বিবাহের জন্য পারিবারিকভাবে সমস্যা ইত্যাদি। সামাজিকভাবে কিংবা আইনের মাধ্যমে হলেও এসব সমস্যা-সমাধান করা উচিত। বিয়েবিচ্ছেদ একবার হয়ে গেলে তা ফেরানো প্রায় অসম্ভব। সাধারণ দৃষ্টিতে বিচ্ছেদ পারিবারিক বিষয় হলেও সার্বিক দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলে বিচ্ছেদ সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। একাধিক সুগঠিত ও সুশৃঙ্খল পরিবার মিলে গঠিত হয় সুশীল সমাজ। আর যারা পরিবার গঠনের উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছে, তাদের বিয়েবিচ্ছেদ হলে পরিবার গঠনের চেতনা বিনষ্ট হয়ে যায়। সমাজে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। সন্তানের লালন-পালন, ভরণপোষণের নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।

আমাদের দেশের ৭৫ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছেন নারী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে ১ হাজার ১৪১টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২। এই হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে বেড়েছে ৯৯টি বিচ্ছেদ।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সবসময়ই নারীর শারীরিক এবং মানসিক প্রয়োজনকে অবহেলা করে এসেছে। যৌনজীবন সম্পর্কে অজ্ঞানতা এবং যৌনজীবনকে গুরুত্ব না দেওয়াটাও বিয়েবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। নারীদের হরমোনাল ইসু্য, প্রিয়ডের সময় চলমান মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বেশির ভাগ পুরুষেরই ধারণা নেই। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সিংহভাগ নারীই স্বামীর কাছ থেকে যতটুকু সহযোগিতার প্রয়োজন তা পান না। সংসারের কাজের ক্ষেত্রে নারীর উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে। সেক্ষেত্রে জেন্ডার শ্রম বিভাজনে চলমান বৈষম্য দাম্পত্য কলহ বাড়িয়ে দেয়।

আসলে বিয়েবিচ্ছেদের কারণ খুঁজলে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। কিন্তু মাঝেমধ্যে সংসারের জন্য হলেও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। বিচ্ছেদ কথাটা খুব ছোট, কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ না। এর সঙ্গে শুধু দুজন মানুষ না, দুটা পরিবারের সবাই জড়িত। বিয়ের মাধ্যমে নতুন একটি সংসারের যাত্রা হয়। কিন্তু সংসার ভাঙনের এই প্রবণতা দিন দিন কেবলই বাড়ছে। যখন পারস্পরিক ভালোবাসা ও বিশ্বাস কমে যায়, তখন সেই সংসারের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে সংসার ভেঙে যায়।

অস্থিরতার মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সুস্থির মনে সিদ্ধান্ত নিলেই সেই সিদ্ধান্ত হবে যথাযথ। এই ভয়াবহ বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য দুজন মানুষকে সব সময়ই একে অন্যের ইচ্ছাকে সম্মান করতে হবে। বিচ্ছেদ কখনই সুখকর হয় না। দুজন কিছুটা সচেতন ও আগ্রহী হলে বিয়েবিচ্ছেদ আটকানো যেতে পারে। তাই সবার উচিত একটি সুখী, সুন্দর পরিবার গড়ে তোলার জন্য বিয়েবিচ্ছেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। বিয়েবিচ্ছেদ শুধু সামাজিক নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করে।

বিচ্ছেদ রুখতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাস আনয়ন করতে হবে। ভারতীয় কূটকাচালি, পরকীয়া ধর্মীয় সিরিয়াল দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।

বিয়ে পরবর্তী দাম্পত্য কলহ নিরসনের ক্ষেত্রে যেমন- সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলিং প্রয়োজন, তেমনি বিয়ের আগেও প্রি ম্যারিজ কাউন্সেলিং প্রয়োজন। বিয়েবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, আইনগতভাবে এই প্রি ম্যারিজ ও ম্যারিজ কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টি যদি অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে বিয়েবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ আরও সচেতন ও বিবেচক হবে।

পরিশেষে বলব একটা সংসার সাজানোর জন্য ধৈর্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়া খুব প্রয়োজন। বিয়েবিচ্ছেদ কখনো মঙ্গলজনক নয়। একটি পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা, পারস্পরিক মর্যাদা থাকা প্রয়োজন। বিয়েবিচ্ছেদ নয় বরং স্বামী-স্ত্রীর গুণে সংসার উষ্ণ থাকুক আজীবন এমনটাই চাওয়া উচিত।

আবির হাসান সুজন

ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে