বেড়েই চলছে বিবাহ বিচ্ছেদ

সমাজ, রাষ্ট্র সব জায়গায় নারীকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করা গেলে বৈষম্য ও শোষণ কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনতা বাড়াতে হবে।

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:২৯

আরিফ আনজুম

বিবাহ বিচ্ছেদ এখন স্বাভাবিক ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলেছে, তা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার, দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন, একসময়ের মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই বিবাহ বিচ্ছেদকে আটকাতে পারছে না। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। আর এই বিবাহ বিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে আছেন। বিচ্ছেদ কেন বাড়ছে? আর কেনই বা নারীরা এগিয়ে আছেন তা নিয়ে নানা কথা রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে এটা সচেতনতার ফল না কথিত আধুনিকতার প্রভাব। বিশেষ করে বিভাগীয় শহর অঞ্চলে ঘর ভাঙার হার সবচেয়ে বেশি। মহামারি মতো সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা। অর্থনৈতিক কারণে বা অশান্তির কারণেও ভাঙন ধরেছে অনেক সংসারে। রাজধানী ঢাকায়ই দিনে ৩৮টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতি মাসে ৯৯টি বিচ্ছেদ বেড়েছে। স্বার্থের সংঘাত, অর্থের অভাব, পর নর-নারীতে আসক্ত ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, যৌতুক, মতের অমিল আর আত্মসম্মান মোকাবিলায় চূড়ান্ত হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন নারীরাই। জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় ভাঙছে একটি সংসার। এক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছেন নারীরা, ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন পুরুষরা। তবে এটা কেবল শহরের হিসাব। করোনার ধাক্কায় আয় সংকুচিত হয়েছে বহু মানুষের। তবে সংকটকালের এই অভিঘাত এখানেই থেমে নেই। পরিসংখ্যান বলছে, ৭৫ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছেন নারী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে ১ হাজার ১৪১টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২। এই হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে বেড়েছে ৯৯টি বিচ্ছেদ। গত বছরও নারীদের তরফে ডিভোর্স বেশি দেওয়া হয়েছে- যা ৭০ শতাংশ। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অশিক্ষিত নারীদের নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে এখন প্রস্তুত নন ছেলেরা। তারা শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে চান, কিন্তু শিক্ষিত মেয়ের চাকরি জীবন, তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, তাকে কিছু বিষয়ে সহযোগিতা করা এসবে পূর্ণ স্বাধীনতা বা সহযোগিতা করতে নারাজ স্বামীরা। ফলে একটি শিক্ষিত মেয়ের যখন আত্মসম্মানে আঘাত আসে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের। যেহেতু সমঝোতা কেবল নারীকেই করতে হয়, তাই মেয়েটি বেছে নেন একলা জীবন। করোনায় অর্থনৈতিক সংকট, মানসিক ও সামাজিক চাপের কারণে কলহ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। এদিকে, সমাজে ছেলেটি শিক্ষিত হলেও তার সঠিক সামাজিকীকরণের কারণে তিনি গতানুগতিক পুরোনো সংসারের ধ্যান-ধারণা লালন করেন। চান, তাদের মা-মাসি বা দাদি-নানিরা যেভাবে শ্বশুরবাড়ির এবং স্বামীর সব সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে সংসারে টিকে থাকতেন, ঠিক তেমনিভাবে এ প্রজন্মের মেয়েটির কাছেও প্রত্যাশা করেন স্বামী পুরুষটি। কিন্তু বর্তমান সমাজের শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীর পক্ষে সেই বউ হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। শুরু হয় সংসারে অশান্তি। ফলে অন্যের বাড়িতে চাপের মুখে কিংবা গুমট পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেন বিবাহ বিচ্ছেদের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে। মহামারিকালে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন। গত বছর রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৮১টি আবেদন করেছিলেন নারী, বাকি ৪ হাজার ৩২টি বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন পুরুষ। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দুই পক্ষ আপস অথবা প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। বেশির ভাগ তালাক দিচ্ছেন নারীরা। শহরাঞ্চলেই ৭৫ শতাংশ তালাক নারীরা দিচ্ছেন। করোনার মধ্যে পারিবারিক বোঝাপড়া নিয়েই মূলত তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে। পাশাপাশি নারীরা এখন বেশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাই তালাকের পর কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। সমাজও এখন মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা স্বাভাবিকভাবে দেখতে শুরু করেছে। বছর দুয়েক আগে ডিভোর্স নেওয়া শায়লা (ছদ্মনাম) তার বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, 'আমার বিয়ে হয়েছিল একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। পরিবারের সবাই শিক্ষিত। শায়লা নিজেও একটি কলেজের শিক্ষক। বিয়ের তিন দিনের মাথায় তার শিক্ষিত শ্বশুর শায়লাকে ডেকে বলেন, 'তুমি যতই শিক্ষিত হও, মনে রাখবে, এ সংসারের বউ তুমি। সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দেবে, এত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা এ বাড়িতে চলবে না। এ কথা শুনে ঘরে এলে শায়লার স্বামী বলেন, তোমার আরো আগেই ঘুম থেকে ওঠা উচিত ছিল, বাবা তো ঠিকই বলেছেন।' এর একদিন পর শায়লা বাপের বাড়ি এসে নিজেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। তিনি জানান, একজন শিক্ষিত মেয়ের নূ্যনতম সম্মান দেওয়া হয়নি ওই বাসায়। বিজ্ঞজনেরা বলেছেন, শহরে ডিভোর্সের মধ্যে নারীরা এগিয়ে থাকলেও সেটা সারাদেশের চিত্র নয়। নিম্নবিত্তের বিয়ে বা ডিভোর্সের কোনো তথ্য নথিভুক্ত সব সময় হয় না। তবে নিম্নবিত্তের মধ্যে স্বামীরাই ডিভোর্স দিচ্ছে বেশি। সেখানে মেয়েটি সংসার টিকিয়ে রাখতে অনেক কিছু সয়ে গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা টিকছে না এবং অনেক ক্ষেত্রে বিয়েটা ঝুলে থাকে। একাধিক জরিপ ও সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাকালে নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক নারী বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৭১ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছেন। আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেড়েছে। আগে প্রান্তিক নারীরা জানতেন না যে তারা তালাক দিতে পারেন। তাই তারা মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করতেন। পাশাপাশি একটা ভুল ধারণা ছিল যে, ডিভোর্স দিলে নারীরা মোহরানার টাকা পাবেন না। এখন এটা বেশির ভাগ নারীই জানেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেছেন, "ডিভোর্সের রেট বাড়ছে। শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না, অনেককে বলতে শোনা যায়, 'আমার বউকে চাকরি করতে দিয়েছি, কেউ বলছে আমার বউমার চাকরি করার দরকার নেই' তার মানে মেয়েটি স্বামী বা শাশুড়ির সিদ্ধান্তে চলছে। তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকছে না। আবার প্রায় শুনতে হয়, আপা আমার স্বামী আমাকে সন্দেহ করে, টু্যরে গেলে সন্দেহ করে এটা মেয়েটির জন্য একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রমা। একজন নারী যত শিক্ষিতই হোক, তার বুদ্ধি কম, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই এমনটা ভাবা হয়। একটা ছেলেকে বড় করতে যে সামাজিকীকরণ, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা বদলাতে হবে। সমাজ, রাষ্ট্র সব জায়গায় নারীকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করা গেলে বৈষম্য ও শোষণ কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনতা বাড়াতে হবে। আরিফ আনজুম : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক