বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের আয় ও ব্যয়

দেশের জনপ্রতিনিধিরা সরকারি কর্মীদের লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ। আর দেখা যায়, জনপ্রতিনিধিরাও সরকারি কর্মীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছেন। এই দুরবস্থা থেকে কাটিয়ে উঠতে হবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

পৃথিবীর কোনো প্রতিষ্ঠান লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাছাড়া অতিরিক্ত কর্মী হয়ে গেলে বা উৎপাদিত পণ্যের অনুপাতে শ্রমিকের সংখ্যার অসামঞ্জস্যতা হলেও কর্মী ছাঁটাই হয়। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মুনাফা অর্জিত না হলে কর্মীর বিষয়টি মালিকপক্ষ ভাবতে শুরু করেন। তখন মালিকপক্ষ কর্মী দক্ষতা বা অতিরিক্ত কর্মীর বিষয় আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করে থাকে। যেমন দেশের কথিত উন্নয়ন সংস্থা- যাকে এনজিও যাদের বলা হয় এদেরও লক্ষ্যমাত্রা আছে। এই এনজিওগুলো দুটি সেক্টরে কাজ করে। একটি হলো অর্থ লগ্নি কার্যক্রম অন্যটি সচেতনতামূলক বা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম। অর্থলগ্নি এনজিওর কার্যক্রমে বাৎসরিক মুনাফা নির্ধারণ করে জনবলসহ অন্যান্য কর্মসূচি ঠিক করা হয়। উন্নয়মূলক প্রকল্পে প্রকল্প শেষে কাঙ্ক্ষিত এলকার জনসাধারণ বা উচ্ছিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে কি ইমপ্যাক্ট দেখা যাবে তা নির্ধারণ করে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। আর এই ইমপ্যাকট মানে ইতিবাচক পরির্বতনগুলো কি কি হবে তা পরিমাপ করার জন্য কিছু সূচক ব্যবহার করে প্রকল্পটি সর্বশেষ মূল্যায়ন করা হয়। আর প্রকল্প চলাকালীন মাঝে মাঝে মনিটরিং করে ত্রম্নটি ধরে কর্মী ছাঁটাইসহ নানা ধরনের সংশোধন করা হয়। সব প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অজর্নের জন্য তাদের কর্মসূচি পরিচালনা করে এবং সেই অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়। করোনা মহামারির কারণে সারা দুনিয়ায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তার কারণ ব্যবসার পরিধি এবং পরিসর কমে গেছে; ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অজর্নে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশে করোনার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যপরিধি এবং আয় কমে যায়। ওই প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মরত কয়েক লাখ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন- যেমন বেসরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেন ও প্রাইভেট স্কুল-কলেজগুলোতে কর্মরত প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক দীর্ঘদিন বেতন পায়নি। পৃথিবীর বহু দেশে করোনা চিকিৎসায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রশাসনিকসহ অন্য সরকারি সেক্টরে কর্মরতদের বেতন ও ভাতা হ্রাস করা হয়। বাংলাদেশের সরকারি পাট কারখানা, সুতা কারখানা, কাপড়ের কারখানা, ম্যাচ কারখানা, রেশম কারখানা, চিনি কারখানাসহ সরকারি সব শিল্প কারখানা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি এই কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কারণে এখানে কর্মরত কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য যে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর আছে সেখানকার কাউকে চাকরি হারাতে হয়নি। তবে লাভ লোকাসানের নিরিখে বুঝা যায় যে, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয় নির্ভর করে আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে। সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে- সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, উপ-সচিব, সিনিয়র সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মীদের। একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, এবারে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যদায় পদোন্নতি পেয়ে দেশে মোট অতিরিক্ত সচিব পদমর্যদার কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০৫ জনে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদ রয়েছে ১১১টি। এই হিসাবে দেখা যায়, অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার অতিরিক্ত কর্মী সংখ্যা ৩৯৪ জন। প্রশাসন স্তরের প্রতিটি পদমর্যাদার কর্মীর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। প্রশাসন ক্যাডারের পাঁচটি স্তরে এমন অতিরিক্ত কর্মীর সংখ্যা প্রায় হাজরের অধিক। এই স্তরের কর্মীদের জন্য সরকারি গাড়ি, বাড়ি, বাবুর্চি, নিরাপত্তা কর্মী, ড্রাইভার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিএস, এপিএস, দারোয়ান, মালীসহ বিভিন্ন ধরনের সাপোর্ট স্টাফের প্রয়োজন হয়। এরকম হাজারের অধিক কর্মী ও তাদের সাপোর্ট স্টাফদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে কি পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করা দরকার। রাষ্ট্রীয় কোষাগার খেকে কেন এই অতিরিক্ত ব্যয় করা হচ্ছে তারও একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প পরিচালনার জন্য লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক থাকে। লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্কে মূলত যে বিষয়টি দেখা হয়- তা হলো, কি ওহঢ়ঁঃ দেওয়া হলো এর ফলে কি ড়ঁঃঢ়ঁঃ হবে তা মাপা, এবং এই পরিমাপ করার জন্য থাকে কিছু গবধংঁৎধনষব ওহফরপধঃড়ৎ। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক স্তরের কর্মী দায়-দায়িত্ব পালনের দেওয়া ঞঙজ বা ঞবৎসং ড়ভ জবভবৎধহপব কতটা মনিটরিং করা হয় তা দেখা প্রয়োজন। এই গবধংঁৎধনষব ওহফরপধঃড়ৎ শুধু আর্থিক হিসাব গণনা করা জন্য সূচক নির্ধারণ করে না। এর সূচকগুলোর মধ্যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, সামাজিক সমৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিসহ থাকে কিছু বিষয়ের সূচক। এই সূচকগুলোর নিরিখে বাংলাদেশ সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মী বাহিনী কতটা ইতিবাচক পরির্বতন ঘটিয়েছে তা দেখা উচিত। ১৯৭২-৭৩ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন, পাটকল, সুতাকল, চিনিকল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, রেশম কারখানা, সরকারি পরিবহণ, রেলওয়ে থেকে যে আয় হতো তা দিয়ে সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ের প্রায় বড় একটা অংশ পূরণ হতো। এ ধরনের আয়গুলো সরকারি কর্মীরা করতেন। বর্তমানে পাটকল, চিনিকল, সুতাকল, রেশম কারখানাসহ সরকারি সব শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানি। তাই সব সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ হয় রাষ্ট্রের কোষাগারের রাজস্ব থেকে। সরকারের প্রশাসন ক্যাডার হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল বিভাগ। এই বিভাগটি আয় ও ব্যয়ের বিভিন্ন দিক নির্ধারণ করে থাকে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত সব শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত আয়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি শিল্প আয় কেন বন্ধ হয়ে গেল এর দায় ভারটা কিন্তু প্রশাসন বিভাগের কর্মীদের। ১৯৭৫ সালের পরর্বতী সময়গুলোতে সরকারে অতিরিক্ত কর্মী থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এত অতিরিক্ত কর্মী থাকার পর কেন সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে আহরিত আয় বন্ধ হলো? এর কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব নেই? কারণ সরকারের প্রশাসন স্তরের কর্মীদের জবাবদিহিমূলক সূচকগুলো অনেকটা ঠবমঁব। জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক। তাই জনগণ তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে পাঠান সরকারি কর্মীদের কাজকর্ম মনিটরিংসহ রাষ্ট্রের আয়বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণের প্রতিনিধিরা কতটা মনিটরিং করতে পারছেন সরকারি কর্মীদের? দেশের কোন কোন খাত থেকে কি পরিমাণ আয় হবে তার বিপরীতে কোন খাতে কি পরিমাণ ব্যয় হবে তারও সঠিক মনিটরিং নেই। কেন নেই তার উদাহরণ হলো, প্রশাসনের এত বিশাল কর্মী বাহিনী থাকার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আবার দেখা যায়, শিল্পকারখানা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার কারণে প্রশাসনের কোনো কর্মীকে চাকরি হারাতে হয়নি। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় যে, কর্মীদের একটি টার্গেট দেওয়া হয়, এই টার্গেটা প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আর্থিক, সামাজিক পরিবর্তনের ইতিবাচক দিকসহ নানা বিষয় ওপর টার্গেটটি নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর এই টার্গেট পূরণ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে বেতন-ভাতা দেওয়া হয় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এই টার্গেটটা নির্ধারণ করা উচিত। যেমন, শিল্প মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাত থেকে কত টাকা আয় করবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া, অনুরূপভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কতটা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রশাসনিকভাবে জনসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত বিভিন্ন দপ্তর কর্তৃক সেবা ও অন্যান্য কার্যক্রমগুলোর কি ধরনের সুফল ভোগ করবে তার একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা এবং তার আলোকে প্রতিমাসে মনিটরিং করা এবং সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমগুলো নিরিখে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা এবং এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচ্চ স্তরের কর্মী থেকে নিন্ম স্তর পর্যন্ত সবার বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া। বর্তমানে সরকারি কর্মীরা নিজেদের জনগণের শাসক মনে করেন।

দেশের জনপ্রতিনিধিরা সরকারি কর্মীদের লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ করতে ব্যর্থ। আর দেখা যায়, জনপ্রতিনিধিরাও সরকারি কর্মীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছেন। এই দুরবস্থা থেকে কাটিয়ে উঠতে হবে।

না তা কাটাতে না পারলে "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার" সংবিধানের এই শিরোনামটি যথাযথ হবে না। তাই পুর্ণাঙ্গ জবাবদিহিমূলক একটি ব্যবস্থা প্রণয়ন আশু প্রয়োজন।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে