পরিবহন শ্রমিকদের অরাজকতা অসভ্যতা ও জনদুভোর্গ

সড়ক-মহাসড়কে আইন ভঙ্গ করে তারা গাড়ি চালাবেন, তাদের খামখেয়ালিপনার কারণে অবলীলায় যাত্রীদের প্রাণ চলে যাবে এটা কোনোভাবেই সমথর্নযোগ্য হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন মেনে গাড়ি চালাতে চালকদের এত আপত্তি কেন। তাদের অবহেলা উদাসীনতা আর খামখেয়ালিপনার কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই, নেই অনুশোচনা। নিজেদের বিবেকের কাছেও তারা একবার প্রশ্ন করেন না। দায় কতর্ব্যবোধ অনুশোচনা থাকলে চালকরা সচেতন হতেন। ধমর্ঘটের নামে নজিরবিহীন অসভ্যতা অরাজকতা সৃষ্টি করতেন না।

প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধমর্ঘটে যে চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠল তা রীতিমতো নজিরবিহীন ভয়ঙ্কর। গাড়িচালক পথচারী ও শিক্ষাথীের্দর মুখে কালি, পোড়া মবিল মেখে দেয়া, সিএনজি রিকশা থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া, তাদের হয়রানি-নাজেহাল করা, চালকদের কান ধরে ওঠবস করানো, ট্রাক চালককে ট্রাকের নিচ দিয়ে যেতে বাধ্য করা এবং দীঘর্ক্ষণ অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখার কারণে নবজাতকের মৃত্যু হওয়া, এসব কিসের আলামত বহন করে। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। এ সব অরাজকতা নৈরাজ্যের কারণে দেশের মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠত হয় যে, সড়কে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। কবে ফিরে আসবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। অবশ্য এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্রা মানববন্ধন করেছে। এই ন্যক্যারজনক ঘটনায় সারাদেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়া উচিত। এই ধরনের ঘটনা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরল। সঙ্গত কারণেই আইন করে ধমর্ঘট নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এই দাবি যৌক্তিক। সদ্য পাস হওয়া পরিবহন আইনের প্রতিবাদে এই ধমর্ঘট ডেকেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। দাবি আদায়ের জন্য ধমর্ঘট তারা ডাকতেই পারে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের দাবি যৌক্তিক কিনা। ধমর্ঘট ডেকে পরিবহন শ্রমিকরা সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে, দেশের মানুষকে গণভোগান্তিতে ফেলবে, এটা কোন ধরনের ধমর্ঘট। তারা আবার হুমকি দিচ্ছে, তাদের দাবি মানা না হলে তারা ৯৬ ঘন্টার ধমর্ঘট ডাকবে। কী ঐদ্ধত্য তাদের? টানা ৪৮ ঘন্টার ধমর্ঘটের কারণে মানুষ দীঘর্পথ পায়ে হেঁটে অফিসে গিয়েছে, যাদের আথির্ক সামথর্্য রয়েছে তারা রিকশায়, সিএনজিতে, পাঠাও কিংবা উবারে কমর্স্থলে গিয়েছে। এই যে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলো, তারা দুভোের্গ ভোগান্তিতে পড়ল এর দায় নেবে কে। এই ধরনের ঘটনা এর আগেও হয়েছে কোনোরকম প্রতিকারহীনভাবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে দেশের মানুষের কি কোনো মূল্য নেই। এ দেশের মানুষই আজ সবচেয়ে মূল্যহীন। পরিবহন ধমর্ঘটসহ নানা ধরনের জঁাতাকলে তারা পিষ্ট। সড়ক-মহাসড়কে আইন ভঙ্গ করে তারা গাড়ি চালাবেন, তাদের খামখেয়ালিপনার কারণে অবলীলায় যাত্রীদের প্রাণ চলে যাবে এটা কোনোভাবেই সমথর্নযোগ্য হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন মেনে গাড়ি চালাতে চালকদের এত আপত্তি কেন। তাদের অবহেলা উদাসীনতা আর খামখেয়ালিপনার কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই, নেই অনুশোচনা। নিজেদের বিবেকের কাছেও তারা একবার প্রশ্ন করেন না। দায় কতর্ব্যবোধ অনুশোচনা থাকলে চালকরা সচেতন হতেন। ধমর্ঘটের নামে নজিরবিহীন অসভ্যতা অরাজকতা সৃষ্টি করতেন না। লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর মাকার্ গাড়ি রাস্তায় চলবে না এটাই স্বাভাবিক। অপরাধ করলে শাস্তি হবে এটাও স্বাভাবিক। অথচ পরিবহন শ্রমিকদের দাবি নতুন এ আইন সংশোধন করতে হবে। ড্রাইভাররা গাড়ি চালাতে গিয়ে মানুষ মেরে ফেলবে, হেলপার গাড়ি চালিয়ে দুঘর্টনা ঘটাবে, অথচ তাদের কিছু বলা যাবে না। তাদের জন্য নতুন আইনও করা যাবে না। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার আর কী হতে পারে? দিন কয়েক আগে সারা দেশে পালিত হয়েছে নিরাপদ সড়ক দিবস। অথচ সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। এর আগে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে যাত্রীকে। দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মারা গেছেন একাধিক ব্যক্তি। অবাক ব্যাপার যে, ঢাকাতে দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখনো চলছে। এর সরল অথর্ হচ্ছে শিক্ষাথীের্দর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কোনো কাজে আসেনি। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সেই পুরনো চিত্রই চোখে পড়ছে। এমন অবস্থায় ধমর্ঘটের নামে দেশবাসী দেখতে পেল নজিরবিহীন নৈরাজ্য অরাজকতা। দীঘির্দন ধরে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বাসের চালক কন্ডাক্টর হেলপার মিলে একের পর এক রোমহষর্ক অপরাধ করেই যাচ্ছে কোনো রকম প্রতিকারহীনভাবে। ফলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও কোনো কাজে আসছে না। সড়কে সেই পুরনো চিত্রই চোখে পড়ছে। গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুঘর্টনায় মারা গেছে ২৫ হাজার ১২০ জন। অথার্ৎ প্রতিদিন গড়ে মারা গেছে ২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছে ৬২ হাজার ৪৮২ জন। গত ১৫ বছরে সড়ক পথে ৫৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৭০ হাজার মামলাও হয়েছে বিভিন্ন দুঘর্টনায়। অন্যদিকে রাজধানীতে বছরে ১৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটছে সড়ক দুঘর্টনায়। ৩ বছরে ৬ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন রাজধানীতে। এর আগে সড়ক দুঘর্টনায় সাংবাদিক মিশুক মুনির ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদের প্রাণ চলে গেছে। দুঘর্টনাকবলিত হয়ে মারা যান প্রশাসনের দুই সচিবও। এসব দুঘর্টনা ৯০ শতাংশ ঘটেছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে। এসব দুঘর্টনায় হতাহত বেশির ভাগ ব্যক্তিই শিশু, তরুণ ও কমর্ক্ষম ব্যক্তি। এদের দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অথর্নীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সড়ক দুঘর্টনায় বছরে আথির্ক ক্ষতির পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ। আর যাই হোক গোড়ায় গলদ রেখে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ সারা দেশের ২০ লাখ চালকের মধ্যে ৯ লাখই ভুয়া। ভুয়া অদক্ষ চালক দিয়ে কীভাবে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে সেটাই আমাদের বড় প্রশ্ন। যদিও ভুয়া চালকদের ব্যাপারে সরকারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ দুঘর্টনার ক্ষেত্রে কোনো মামলা হয় না। আবার মামলা হলেও নিষ্পত্তি হতে দীঘর্সময় লাগে। ফলে ভুক্তভোগীরা হতাশ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে কোনো শঙ্কাবোধও করেন না। এ কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব অপরাধ। চালকদের খামখেয়ালিতে আগামীর স্বপ্নগুলোর এভাবে অপমৃত্যু ঘটবে, তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সরকার যে নতুন আইন পাস করেছে, এই আইনে তিন বছরের সাজা ৫ বছর করা হয়েছে। মামলা অজামিনযোগ্য, তাতে কী? এ ব্যাপারে যে চালকদের কোনো ভয় নেই তা দুঘর্টনার চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। এখন আবার তারা সংসদে পাস হওয়া আইনের পরিবতর্ন চাচ্ছে। কী আবদার? মনে রাখতে হবে, বড় বড় দুঘর্টনা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে না পারি তবে ভবিষ্যতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। চালকদের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি দুঘর্টনা রোধে অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে গাড়ির চালকদের আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। আর যাই হোক গাড়িচালকদের খামখেয়ালিপনার কাছে দেশের জনগণ জিম্মি হতে পারে না। দ্রæত এ অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। কারণ সড়কের নিরাপত্তা মানেই জীবনের নিরাপত্তা। চালকের কাছে মানুষের জীবন জিম্মি হয়ে পড়বে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ ছাড়া রয়েছে দেশের সড়ক-মহাসড়কের করুণ অবস্থা। দেশের সড়ক-মহাসড়কের দুদর্শার কারণে মানুষের ভোগান্তি ও দুদর্শা বেড়ে যাবে তারা দুঘর্টনাকবলিত হয়ে মারা যাবে, এমন পরিস্থিতিও আমাদের প্রত্যাশিত নয়। মহাসড়ক ধরে চলতে গেলেই এখানে-সেখানে সাইনবোডের্ লেখা দেখা যায়, ‘সাবধান, সামনে দুঘর্টনাপ্রবণ এলাকা’ পথ চলতে গিয়ে এমন সাবধানবাণী অবশ্য গাড়ির চালকরা কমই মানেন। ফলে প্রায় প্রতিদিনই আসে মমাির্ন্তক সব দুঘর্টনার খবর। গাড়িচালকদের এ উদাসীনতা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার কী করছে, সে প্রশ্ন তুলছেন সড়ক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুঘর্টনা গবেষণা সেন্টারের একটি হিসাব অনুযায়ী যানবাহনের তুলনায় সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যুর হার পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু হয় ৮৫টি। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এ হার প্রায় ৫০ গুণ বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে সড়ক দুঘর্টনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির অন্তত দুই শতাংশ হারিয়ে যায়। সবকিছু ছাপিয়ে ইদানীং সড়ক দুঘর্টনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে সড়ক দুঘর্টনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, এ কথা এখন ধ্রæব সত্য। অথচ এর কোনো প্রতিকার নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দীঘির্দন থেকে দেশের পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য চলছে। এর লাগাম টেনে ধরতে হবে। কারণ এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সময় থাকতেই কতৃর্পক্ষের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। সেই সঙ্গে অপরাধীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিকল্পিত ও সফল উদ্যোগই কেবল পারে এমন মমাির্ন্তক মৃত্যু রোধ করতে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক