পাঠক মত
বিচ্ছেদই কি সমাধান?
প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
সম্পর্ক হলো একটা গাছের মতো, যাকে প্রতিদিন পানি দিয়ে যত্ন করতে হয়। ঠিক তেমনি যত্ন করতে হয় পারিবারিক তথা সাংসারিক জীবনকে। শুধু আবেগ নয়, প্রয়োজন হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ ও বিশ্বাসের। দুঃখজনক হলেও সত্যি, উলেস্নখযোগ্য হারে দিন দিন বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। আর এই বিবাহ বিচ্ছেদে নারীরাই এগিয়ে। ঢাকায় সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া এক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বিচ্ছেদটা তিনি নিজেও চাননি। পূর্ব রাগের কারণেই এক মেধাবী তরুণকে তিনি বিয়ে করেন। তার মতে বিয়ের আগের সেই পুরুষটি বিয়ের পর অন্যরকম হয়ে যান। সারাক্ষণ সন্দেহ, আগের বন্ধুদের সহ্য না করা এসব নিয়ে সমস্যা তো ছিলই এমনকি গায়ে হাত তুলতেও পিছপা হননি। তাই বিয়েটি এক বছরের বেশি সময় টেকানো যায়নি। তিনি বলেন সন্তান আসার আগেই বিচ্ছেদ হওয়ায় ভালো হয়েছে। সন্তান থাকলে তাদের উপর বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। এখন যা হওয়ার তা আমার নিজের হলো। তবে এরকম বিচ্ছেদের কাহিনী পুরুষের দিক থেকেও আছে। আর এসবে পরস্পরকে দোষারোপ অবধারিত। কোনো পক্ষই এখন আর মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করতে চান না। চান না সারাজীবন ভালোবাসাহীন সংসার-ধর্ম পালন করতে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন পুরুষ ৩০ শতাংশ এবং নারী ৭০ শতাংশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুটি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয় ২৩০৯টি, যার মধ্যে ১৬৯২টি স্ত্রী কর্তৃক ও স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বিচ্ছেদের সংখ্যা ৩৫৮৯টি। এর মধ্যে ২৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক হয়েছে ১২০৮ টি। একাধিক পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে মাত্র তিন বছরে ঢাকা শহরে বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হলো- যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, মতের মিল না হওয়া, শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি, চাকরি করতে না দেওয়া বা স্বাবলম্বী হতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি। পুরুষের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা, স্বামীর কথা না শোনা, যৌথ পরিবারে থাকতে না চাওয়াসহ নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের পথ বেছে নিচ্ছেন পুরুষরা। তবে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের সচেতনতাও বাড়ছে। বাড়ছে স্বনির্ভরতা, তাই তারা আর মুখ বুজে অত্যাচার এবং অনাচার সহ্য করতে চাইছেন না। একাধিক জরিপ ও সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাকালে নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক নারী বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকেছেন। বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান শিকার হন সন্তানরা। তারা বেড়ে ওঠে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সন্তান যদি বাবা-মায়ের স্বাভাবিক সঙ্গ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় তা হলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। তাদের মধ্যে জীবনবিমুখতা তৈরি হয় এবং তারা সমাজকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখে। বাস্তবতা হলো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা অনেক কমে গেছে। অনেক সময় বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করলেও দুই পক্ষকে বুঝিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটার হার খুবই কম। মাদকাসক্তি, মোবাইল ফোন আসক্তি, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণেই মূলত বিবাহ বিচ্ছেদের হারও প্রবণতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সহনশীলতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে ও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিবাহ ভাঙার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বরপক্ষের যৌতুকের চাপ ও কনেপক্ষের দেনমোহরের চাপও এর জন্য দায়ী। করোনাকালে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে মূলত চারটি কারণে- অর্থ সংকট, বাল্যবিবাহ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। এ প্রবণতা সামনে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন এ সমাজবিজ্ঞানীরা। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। শহর থেকে মানুষ গ্রামে ছুটছে। সেখানে গিয়ে মেয়েদের নির্দিষ্ট বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে অল্প বয়সে সংসারজীবনে মানিয়ে নিতে পারছে না তারা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার না করে তার অপব্যবহার বাড়ার কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটছে। এর মাধ্যমে একজন একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে ও সংসার ভেঙে যাচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দিন দিন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। যুক্তির চেয়ে তাৎক্ষণিক আবেগের কারণে দ্রম্নত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকে। তা ছাড়া নারীরা আগের চেয়ে শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সংসারে ভূমিকা ও অধিকারের স্বীকৃতি চান তারা। কিন্তু অনেক পরিবারেই স্ত্রীদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা দিতে চান না স্বামীরা। তখনই দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টি হয়। এরই পরিণতি বিচ্ছেদ। বিবাহ বিচ্ছেদ এড়াতে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। বিশ্বাসহীনতা বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সহনশীলতা ও সমঝোতার মানসিকতা। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সৎ থাকার মানসিকতা এড়াতে পারে বিবাহ বিচ্ছেদ। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা রাখা ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭'তে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছর করা হয়েছে। বয়সের ব্যাপারটা এ জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিয়ের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়, ক্যারিয়ার নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তায় পরিবারকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছুটির দিনেও নিজের আপন মানুষকে সময় না দিয়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন অনেকে। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও কিছু সময় বের করা উচিত পরিবারের জন্য। ভুল সবারই হতে পারে, তাই করলে একে অন্যকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ভালো। কেউ আগে ক্ষমা চাইলেই সে ছোট হয়ে যাবে, এমন মনোভাব রাখা উচিত নয় এবং ভুলটা যেই করুক তা বাইরের কারও সামনে না বলাই ভালো। সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করায়। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বিয়ের পর কিছু দায়িত্ব যোগ হয়। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। আবার ছেলের বউ আসলে সব দায়িত্ব তার উপর এই চিন্তা করা উচিত নয়, সময় দিন সবকিছুর জন্য। বর্তমানে অনেক মেয়েরাই চাকরিজীবী। বিয়ের পর সংসার ও অফিস দুটোই সামলানো অনেক কঠিন। তাই দায়িত্ব চাপিয়ে না দিয়ে কাজ ভাগাভাগি করুন। সর্বোপরি, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করা উচিত। যখন পারস্পরিক ভালোবাসা ও বিশ্বাস কমে যায় তখন সেই সম্পর্কের বন্ধন হালকা হয়ে যায়। একপর্যায়ে সেই সংসার ভেঙে যায়। এই ভয়াবহ বিচ্ছেদ ঠেকাতে দুজন মানুষকে সবসময়ই একে অন্যের ইচ্ছের সম্মান করতে হবে এবং একটি সুখী, সুন্দর ও সুস্থ পরিবার গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
ফারজানা আক্তার বিথী
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়