পাঠক মত

নদী বাঁচাও দেশ বাঁচাও

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পৃথিবীর আদি সভ্যতা ও মনুষ্যবসতি নদীতীরেই। মানবসভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ইরাকের ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস নদের সুমেরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদের মোহেনজোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদী সভ্যতা এবং মিসরীয়দের নীলনদের সভ্যতা। এমনকি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বেনিয়ারা নদীপথে দিয়ে যাতায়াতের মাধ্যমে সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত আবার ফিরে এসে বসতি স্থাপন করত। পশ্চিম- উত্তর-পূর্ব তিনদিক থেকেই অসংখ্য নদনদী আমাদের দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আর এসব নদ-নদীর তীরে বাঙালি জাতির বসবাস এবং বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশে নামে পরিচিতি আছে। এ দেশের মানুষ নদীর পানি দিয়ে আঁশ পাট, ধানসহ প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন করে জীবন নির্বাহ করে। আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণের জন্য নদীতে সুস্বাদু হরেক রকমের মাছ এবং মাছের রাজা ইলিশ পাওয়া যায়। যার কারণে আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালি বলা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যত দিন যাচ্ছে ততই যেন নদীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমার বাড়ি থেকে তিস্তা নদী পাঁচ কিলোমিটার দূরে। এ নদীতে আমার শৈশব ও কৈশোর জীবনে স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা জড়িয়ে আছে। স্কুলজীবনের কথা, দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। বাবা রাতে আমার পড়ার টেবিলের কাছে এসে আমাকে একটা লিফলেট হাতে দিয়ে বলত এখানে যা আছে একটু সুন্দর করে পড়ো। লিফলেট হাতে নিয়ে দেখলাম তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বাসদের ঢাকা থেকে তিস্তা ব্যারেজ রোর্ডমাচ। ওই প্রোগ্রামে উপস্থিত থেকে স্স্নোগান ধরতাম 'তিস্তা নদী আমার মা, মরুভূমি হবে না। ভারতীয় আগ্রাসন রুখো বাংলার জনগণ। তিস্তার পানি ন্যায্য হিস্যা, দিতে হবে দিয়ে দাও। নদী বাঁচাও, দেশে বাঁচাও।' কিশোর বয়সেও আংশিক বুঝে নদী রক্ষার আন্দোলনে যেতে হয়েছে। অথচ আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। কিন্তু নদী বাঁচাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কি? এত বছরে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু নদীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যেটা ঘটেছে দিনের পর দিন নদী বিলীন হয়েছে। নির্বাচনের আগে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে জনগণের কাছে নদী রক্ষার প্রতিশ্রম্নতি দেন কিন্তু ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দাদা বাবুদের ওপর প্রতিবাদ করার সাহস থাকে না। মা যেমন বুকের দুধের প্রবাহ দিয়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের নদনদী বুকের দুগ্ধসম জলধারা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের সন্তান, এ দেশের জনগণকে। গবেষকদের জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪৭ বছরে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নদী শুকিয়ে গেছে কিংবা মরে গেছে। আর সরকারি তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০৫-এ। আর বেসরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০। কোন পথে যাচ্ছে দেশ? আমাদের নদীগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছে? সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এতে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদার ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও চালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ কতটুকু কার্যকর? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি, জলাভূমি, বনভূমি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নদী দখল করে রাখে। আমাদের দেশে নীতি, আইন, পরিসংখ্যান সব আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় যদি নদীর জমি ব্যক্তির নামে খারিজ না করত কিংবা খাজনা না নিত, তাহলে সেই জমিতে ব্যক্তি কখনোই মালিকানা দাবি করতে পারত না। কিন্তু গোটা দেশে এমনি চিত্র দেখা যায়। এর দায় ভূমি কি অফিসের সহকারী কমিশনার এড়াতে পারেন? দেশের পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর কারণে ১৮ কোটি মানুষের পানির অধিকার হরণ করা যাবে না। নদীকে ধ্বংস করে দেশের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা যাবে না। আমরা হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারব কিন্তু একটি নদীও সৃষ্টি করার সামর্থ্য কারও নেই। ফলে নদী ধ্বংসের আয়োজন থেকে দূরে আসতে হবে। অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি অমিমাংসিত ইসু্য। দু'দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানির বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি কেন? ভারত তিস্তা নদীতে বাংলাদেশের উজানে গজল ডোবায় ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার পানি অনৈতিক ও একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো কৃষি হুমকির মুখে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এর জন্য উত্তরবঙ্গ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখী। শুধু তিস্তা নয়, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে বাঁধের মালায় বাংলাদেশকে ঘিরে ফেললে তা বাংলাদেশের প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ ভয়ংকর ঝুঁকিতে ফেলবে। ইতোমধ্যে ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবন হুমকির মুখে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা এবং রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ঘটে চলছে। এতে প্রতিবছর লাখ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের। কিন্তু সরকারের নতজানু হয়ে থাকে কেন? আমরা কি পানির ন্যায্য অধিকার পাব না? বাংলাদেশ নদী ও পানির দেশ। পানির প্রবাহ বন্ধ হলে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই নদীর প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। শুধু সম্পদ আহরণ করলে চলবে না। কে নদী দখল করে নিয়েছেন, কে নদীদূষণ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ওয়াসা থেকেও প্রতিদিন নদীতে ময়লা ফেলতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী রক্ষায় সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। আমাদের যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে সেই সরকারের উচিত বাংলাদেশের নদনদী রক্ষার ইসু্যটি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করা। পদ্মা, তিস্তাসহ সব নদনদীতে ভারত সীমান্ত ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ করা যাতে বন্যার সময়ে পানি আটকিয়ে দিয়ে অন্তত বন্যার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়। এক দেশ থেকে অন্যদেশে যখন একটি প্রবাহিত হয় তখন সেই নদীকে বলে আন্তর্জাতিক নদী। আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে কোনো নদীকে কেউ বাঁধ দিয়ে আটকে রাখতে পারবে না কিন্তু আমার বন্ধু দেশ ভারত গ্রীষ্মের সময় তিস্তার গজল ডোবায় বাঁধ পানি আটকে রাখে। অথচ আমরা কেউ বন্ধুত্বের সহানুভূতি দেখাই আবার কেউ হিন্দু রাষ্ট্র বলে ক্ষমতার মসনদে বসে থাকে। প্রতিবাদ করার মানুষিকতা দেখা যায় না। নদী বিপন্ন করে মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে রাখা রাষ্ট্রের উচিত নয়। কারণ নদী হচ্ছে পৃথিবীর ধমনির মতো। এর প্রবাহমনতাই সত্যিকার অর্থে আমাদের জীবন রক্ষাকারী। তাই নদী বাঁচলে, মানুষ বাঁচবে আর মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। রাশেদুজ্জামান রাশেদ সংবাদকর্মী ও প্রাবন্ধিক