মা দুর্গা

আমরা মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করি বিশ্বব্যাপী করোনায় যে মহামারি আকার ধারণ করেছে সে থেকে যেন আমরা পরিত্রাণ পাই। এ করোনায় আমরা কাছের অনেক আপনজনকে হারিয়েছি। তাদের জন্য শ্রদ্ধা রইল। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনা করি।

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
দুর্গাপূজা শক্তির পূজা। দেবী দুর্গা শক্তিদায়িনী। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটে তিনি মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছেন বিভিন্নরূপে, বিভিন্ন নামে। তাই তার নাম দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চন্ডী, লক্ষ্ণী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা ইত্যাদি। দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রম্নর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই মা দুর্গা। বিপদনাশিনী দুর্গা। দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় মার্কন্ড পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী, দেবী ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থের ভিত্তিতে। এই গ্রন্থগুলো অনেক পুরনো। তার থেকে নির্বাচিত সাতশ'টি শ্লোক নিয়ে যে সংক্ষিপ্ত মার্কন্ডেয় পুরাণ করা হয়েছিল তাকেই বলা হয় 'দুর্গাশপ্তশতী', কথ্য ভাষায় বলা হয় শ্রীশ্রীচন্ডী। চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যা ও জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নাম ধারণ করে ধরাধামে আসেন। পুরাণের মতে, শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্র তেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জংঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল।... মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি... (দ্রঃ হংসনারায়ণ, ১৯৮০, ১৭৫) এই হলো বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। তান্ত্রিক সাধকরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাকে নারীমূর্তিতে কল্পনা করেছেন। সনাতন ধর্মমতে, বস্তুত যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবী লক্ষ্ণী, সর্বসিদ্ধিদাতা গনেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য সিদ্ধি বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথানুসারে দুর্গোৎসব দশ বা পাঁচ দিনের। দুর্গা পূজার শুরু হয় মহালয়া থেকে। এ দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয়। ভোরবেলা পিতৃতর্পণের মাধ্যমে দেবীপক্ষকে আহ্বান জানানো হয়। শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকার হরণ করে শুভ, মঙ্গল, আনন্দদায়ক ও আলোর দিশারী অসুরবিনাশিনী মাকে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেয়া হয়। সমবেত কণ্ঠের স্তোব উচ্চারিত হয়- 'হে দেবী, তুমি জাগো, তুমি জাগো, তুমি জাগো। তোমার আগমনে এই পৃথিবীকে ধন্য করো। কলুষতা মুক্ত করো। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে আশীর্বাদ করো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের অসুর প্রবৃত্তিকে।' এর ঠিক পাঁচদিন পর মহাষষ্ঠীতে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিলবৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা। মহাষ্টমীতে মহাষ্টম্যাদিকল্পারম্ভ, কেবল মহাষ্টমীকল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা, বীরাষ্টমীব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস, কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা ও মহোৎসবযাত্রা, সন্ধিপূজা ও বলিদান। মহানবমীতে কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা। বিজয়া দশমীতে বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। এইদিন দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। সেই থেকে শরৎকালে হয়ে আসছে দুর্গা পূজা। পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিন বিজয়া দশমী। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ছেড়ে আবার কৈলাসে ফিরে যাবেন স্বামীর ঘরে। সঙ্গে নিয়ে যাবেন ভক্তদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বেদনাশ্রম্ন। সকালেই দেবীর দশমীবিহিত পূজা সমাপণ ও দর্পণ বিসর্জনের পর্ব শেষ হবে। প্রতিমা বিসর্জনের আগে ভক্তিমতি রমণীরা দেবী দুর্গাকে বেদনাবিধূর বিদায়লগ্নে তেল, মিষ্টি, ধান, দুর্বা, সিঁদুর ও পান দিয়ে ভোজন করাবেন। এরপর শোভাযাত্রা সহকারে দেবী প্রতিমার বিসর্জন হবে। ভগ্নমনোরথে ভক্তরা মন্দিরে ফিরে শান্তিজল ও আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে যাবেন আপন ঘরে। বর্তমানে দুর্গাপূজা দুইভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে- ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে। ব্যক্তিগত পূজাগুলোর আয়োজক মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলো। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন- যা বারোয়ারি পূজা নামে পরিচিত। আমরা মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করি বিশ্বব্যাপী করোনায় যে মহামারি আকার ধারণ করেছে সে থেকে যেন আমরা পরিত্রাণ পাই। এ করোনায় আমরা কাছের অনেক আপনজনকে হারিয়েছি। তাদের জন্য শ্রদ্ধা রইল। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনা করি। তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ