শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আর কতদূর নিয়ে যাবে হে সুন্দরী

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটাই চাওয়া, প্রত্যেকদিন বাজারে গিয়ে তাদের যেন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে না হয় আকস্মিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষায় বেতন ও দ্রব্যমূল্যের মধ্যে সাম্য প্রয়োজন। তাই বলতে ইচ্ছে করে- আর কতদূর নিয়ে যাবে হে সুন্দরী (সুন্দরী - ঊর্ধ্ব দ্রব্যমূল্য)।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার অনন্য একটা বৈশিষ্ট্য আছে, মানুষের চিন্তা-ভাবনার সময় প্রতিটি দিক তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত। এখানে নিজের প্রয়োজনে তাঁর একটা বিখ্যাত কবিতার (সোনার তরী) একটা চরণ নেওয়া হয়েছে বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য। কবিতায় আছে- তাঁর সোনার নৌকো কতদূর নিয়ে গিয়ে কোথায় তা ভিড়বে কবি তা জানেন না। বাংলাদেশের দ্রব্যের মূল্যস্ফীতির অবস্থাও সমশ্রেণির।

বাংলাদেশের অনেক পাঠকের কাছেই কলকাতার 'আনন্দ' প্রকাশনীর শারদীয় সংখ্যা অত্যন্ত প্রিয় এবং অনেকেই প্রকাশিত সব সংখ্যাই কিনে পড়তে চান। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই শারদীয় সংখ্যার পেছনের অংশে ভারতের মূল্য ও বাংলাদেশের মূল্য পত্রিকার পক্ষ থেকেই মুদ্রিত থাকত। যেমন ভারতীয় মূল্য একশ টাকা, বাংলাদেশের মূল্য একশ পঁচিশ বা একশ পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু গত বছর থেকে ওই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছরের শারদীয় সংখ্যার মূল্য দেখলে চমকে উঠতে হবে। পত্রিকায় শুধু ভারতীয় মুদ্রায় মূল্য দেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশে পত্রিকা আসার পর এখানকার এজেন্টরা স্টিকার সেঁটে দ্বিগুণ দাম করেছে। যেমন- আনন্দ মেলা, আনন্দ লোক, দেশ ও সানন্দার চাহিদা বেশি বলে এগুলোর মূল দাম দুশো টাকার (রুপি) ওপর ছোট কাগজ লাগিয়ে দাম করা হয়েছে চারশ টাকা। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার এই অধিকার কেউ তাদের দেয়নি। এভাবে মূল্য বৃদ্ধির ফলে ক্রেতাকে দ্বিগুণ দামে পত্রিকা কিনতে হয়েছে। এখানে আরও একটা দিক লক্ষ্য করা প্রয়োজন, আনন্দ প্রকাশন প্রতিটি পত্রিকার জন্য কুড়ি থেকে তিরিশ পার্সেন্ট কমিশন দিয়ে থাকে (হিসাবে সামান্য ভুলও হতে পারে)। শুধু তাই নয়, আনন্দ প্রকাশনের অফিস থেকে যে কেউ শারদীয় সংখ্যা কিনলে কমিশন দিয়ে থাকে। এই দিকটি লক্ষ্য করে বলা যায় যে, দুশো টাকার পত্রিকা তার চেয়েও কম দামে কিনে চারশ টাকায় বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা লাভে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ পাঠকরা, যাঁরা প্রতি বছর এই শারদীয় সংখ্যার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন।

পত্রিকার মূল্যবৃদ্ধির মতো অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সপক্ষে দৃষ্টান্তের অভাব নেই। অনেককে শারীরিক প্রয়োজনে সবুজ আপেল খেতে হয়। সবুজ আপেলের দাম (এক কেজি) ১৬০ থেকে বাড়তে বাড়তে ২২০ টাকায় পৌঁছে যায়। এখানে মূল্য বৃদ্ধির পেছনে অর্থনীতির কারণ বিদ্যমান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেখানে দাবির তুলনায় দ্রব্য কম সেখানে মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। এই কারণে সবুজ আপেলের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার দাম কমতে শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়া সহজাত হলে মানুষকে আর দুর্ভাবনার শিকার হতে হতো না।

বাংলাদেশে কখন যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ক্রেতা সম্পদ্রায়ের ওপর আঘাত করবে তা কেউ জানে না এবং এই অপ্রস্তুত অবস্থায় দ্রব্যের বর্ধিত মূল্য গলাধঃকারণ ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে মূল্য বৃদ্ধি হয় বলে জানা নেই। কোনো একটা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে কিন্তু প্রায় সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ভোক্তার কোমর ভেঙে দেওয়ার মতো। আরও একটি দিক এখানে লক্ষ্যণীয়, কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হলে তা কোনো ক্রমেই হ্রাস পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে না। ক্রেতা সাধারণকেও এই মূল্য মাথা পেতে নিতে হয়। এখন হয় কি না জানি না, আগে রোজার সময় প্রত্যেক বছর গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি পেত এবং তা কমার লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়নি। এর ফলে মাংসের যে দাম হয়েছে তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার অনেক ঊর্ধ্বে।

এ দেশে ভোজ্যতেলের দাম এক সঙ্গে চারবার বাড়ার পর পঞ্চম দফায় আরেকবার বেড়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, বিদেশে তেলের দাম বাড়ার কারণে এখানেও বাড়াতে হয়েছে, কিন্তু বিদেশে একলাফে কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ে বলে অনেকেই মনে করেন না। ভোজ্যতেল যে কত প্রয়োজনীয়, তা সবারই জানা আছে। বর্তমানে এক কেজি চিনির দাম সত্তর টাকার ওপরে, এই দাম কম বলে মনে করার উপায় নেই। গুঁড়ো দুধ, হরলিকস সবেরই দাম বেড়েছে। এক সময় মিল্ক ভিটা তরল দুধ ছাড়াও বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম, রঙিন দুধ তৈরি করত এবং তার চাহিদাও ছিল। এখন বাজারে মিল্ক ভিটার গুঁড়ো দুধ চোখে পড়ে না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুধের আকালের সময় মিল্ক ভিটাই দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়েছে। শুধু তাই নয়, যখন মিল্ক ভিটা তরল দুধ বোতলে সাঁইত্রিশ পয়সায় বিক্রি করত তার স্বাদ সেদিন যারা এই দুধ পান করেছেন তাঁরা আজও ভুলতে পারেননি। শুনলে অনেকের বিশ্বাস হবে না, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পাঁচ পাউন্ড ডানো পাউডার দুধের দাম ছিল পঁয়ত্রিশ টাকা। উন্নত মানের ফ্রিশিয়ানা গুঁড়ো দুধ তো এখন আর বাজারে পাওয়াই যায় না। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, গুঁড়ো দুধ শুধু আমাদের মানুষের ব্যবহারের জন্য, পাশ্চাত্য দেশের মানুষ তরল দুধ ব্যবহার করে। বাইরের গুঁড়ো দুধ আমদানি করে যে টাকা ব্যয় করা হয় তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মিল্ক ভিটার পেছনে ব্যয় করলে দেশে গুঁড়ো দুধের অভাব মিটত অনায়াসে। লকডাউনের সময় বিক্রির অভাবে দুধ মাটিতে ফেলে দিতে হতো না ক্ষোভে, দুঃখে।

এ দেশে গুঁড়ো দুধের আবির্ভাব চায়ের মতোই। চায়ের পাতা বিক্রির আগে তা ঘাট-বাজারের মানুষকে চা করে বিনামূল্যে পান করানো হতো। মানুষ বিনা পয়সার চায়ে আসক্ত হয়ে পড়লে তখন প্যাকেটে চা বিক্রি করা শুরু হয়। গুঁড়ো দুধের ইতিহাসও অনেকটা সমশ্রেণির। আমরা যখন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র (উনিশশো বাহান্ন হবে) তখন টিফিনের আগে দৈত্যকার পাত্রে গুঁড়ো দুধে পানি দিয়ে তরল করা হতো এবং টিফিন হলেই ছাত্রদের ডেকে ডেকে দুধ দেওয়া হতো। এই দুধের প্রতি আমাদের কোনো আকর্ষণ ছিল না বলে দূরে পালিয়ে যেতাম। এক দিন আমাদের ধরে জোর করে দুধ পান করতে দেওয়া হলো। দুধ খেতে ভালোই লেগেছিল এবং পরে নিজেরাই দুধের জন্য লাইন দিতাম। এর বহু পরে আমাদের দেশে গুঁড়ো দুধের প্রচলন হয়।

ওপরের কাহিনি দ্রব্যের প্রসার ও দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জড়িত বলে অপ্রাসঙ্গিক নয়। দিন দিন মানুষের বয়স বাড়ছে এবং তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে দ্রব্যমূল্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক হতো যদি প্রতি বছরে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেক মানুষের বেতনের হার বৃদ্ধি পেত। কানাডায় উনিশশো সত্তরে এক কাপ কফির দাম ছিল দশ সেন্ট, বর্তমানে তার দাম এক ডলার বা তার সামান্য বেশিতে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেখানকার নাগরিকদের বেতনও সেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কারও গায়ে লাগে না।

বাংলাদেশে অনেক সময় পণ্যের গায়ে মূল্য লেখা থাকে কিন্তু উৎপাদনকারীর মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ভুটান ও সাইপ্রাসের জুসের মান বেশি ভালো বলে অনেকেই এই দু'দেশের জুস কিনে থাকেন। ভুটানের নিউট্রোলাইফ এক লিটার জুসের দাম একশ রুপি, আর বাংলাদেশে এসে এর দাম হয়ে যায় দুশো পঁয়তালিস্নশ টাকা। দোকানিরা বিক্রি করেন দুশো কুড়ি টাকায়। সাইপ্রাসের জুসের গায়ে এ দেশের টাকায় দাম লেখা থাকে তিনশ টাকার বেশি। দোকানে এগুলো বিক্রি হয় সাধারণভাবে তিনশ কুড়ি টাকায়। এভাবে অনেক দ্রব্যের গায়ে বর্ধিত মূল্য নির্দেশ করা হয় বলে ক্রেতাদের বিভিন্ন দোকানে বিভিন্ন দামে কিনতে হয়।

দ্রব্যমূল্য ও ভোক্তাদের আয় একই অক্ষে বিচরণ করলে দ্রব্যমূল্য কিনতে ব্যবহারকারীদের কোনো অসুবিধে হতো না। কিন্তু দুঃখের বিষয় আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে মিল না থাকায় সাধারণ মানুষকে জিনিস কেনার সময় বারবার পকেটে হাত দিতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে একজন জাপানির মানসিকতার দিক উলেস্নখ করা যেতে পারে। ভদ্রলোক প্রত্যেকদিন সকালে বাড়িতে সংবাদপত্র এলেই জাপানি ইয়েনের মুদ্রামান পড়তেন। একদিন কৌতূহলী হয়ে তাঁকে কারণ জিজ্ঞেস করার পর তিনি হেসে বললেন, এর কারণ কী জানো? ইয়েনের মান বেড়ে গেলে আমরাও বেশি ইয়েন পাব বেতনে। ভদ্রলোকের কথা শুনে খারাপ লাগেনি, বেতন বৃদ্ধি হলে তাঁর মুখে হাসি ফুটবে বিভিন্ন দ্রব্য কেনার ক্ষমতা বাড়বে বলে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটাই চাওয়া, প্রত্যেকদিন বাজারে গিয়ে তাদের যেন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে না হয় আকস্মিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষায় বেতন ও দ্রব্যমূল্যের মধ্যে সাম্য প্রয়োজন। তাই বলতে ইচ্ছে করে- আর কতদূর নিয়ে যাবে হে সুন্দরী (সুন্দরী - ঊর্ধ্ব দ্রব্যমূল্য)।

আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে