শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

মাদকের ছোবল

নতুনধারা
  ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে মাদকাসক্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের মাত্রাও বেড়েছে। শহর থেকে গ্রাম, অলি থেকে গলি সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে মাদকের বিষাক্ততা। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক নানা কারণে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না মাদকের অবাধ সরবরাহ। মাদকের সহজলভ্যতা, হতাশা, একাকিত্ব, বিষণ্নতা, কৌতূহল, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, অপসংস্কৃতি, প্রেম ও চাকরিতে ব্যর্থতা বা বেকারত্বসহ বিভিন্ন কারণে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এ দেশের হাজারও মানুষ। যার মধ্যে একটা বড় অংশ হচ্ছে কিশোর এবং তরুণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বাংলাদেশে কয়েক মিলিয়ন মানুষ মাদক গ্রহণ করে এবং মাদকের পেছনে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। মাদক বিক্রেতাদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে দেশের কর্মক্ষম যুবসমাজ। যাদের হাত ধরে জাতি আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- বর্তমানে আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশ সর্বনাশা মাদকের শিকার। আজকাল এসব মাদকাসক্তদের দ্বারা সমাজে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গুম, খুনের মতো ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে। যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভয়াবহ সতর্কবার্তা দিচ্ছে। মাদকাসক্তদের অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করে এবং একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করে থাকে। যার ফলে এইডসের মতো সংক্রামক রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আজকাল মাদক গ্রহণের কারণে মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির কিডনি, লিভার ছাড়া মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে। বিশেষজ্ঞদের মতে মাদকাসক্তদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অন্য যে কারও তুলনায় বেশি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাদকের সঙ্গে এ দেশের মানুষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সূচনীয় পরাজয়ের পর ইংরেজরা চলে আসে বাংলার শাসন ক্ষমতায়। তারপর একের পর এক বাঙালি জাতির উপর চলতে থাকে অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার। একপর্যায়ে চিরসবুজ এই বাংলার কৃষকদের প্রতি নজর পড়ে ইংরেজদের। সুযোগ পেয়েই ভারতবর্ষের উর্বর মাটিতে শুরু হয় আফিমের চাষাবাদ। কৃষকদের দিয়ে জোর করিয়ে আফিম চাষ করিয়ে তা বিক্রি করা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাছাড়া এ দেশেও প্রকাশ্যে দোকান দিয়ে অবাধে বিক্রি হতো আফিম। ঐতিহাসিকদের ধারণা বঙ্গদেশের সঙ্গে আফিমের সম্পর্ক আরও পুরনো। পর্তুগিজ পর্যটক পাইরেসের লেখায় আফিমের উলেস্নখ পাওয়া যায়। বস্তুত সে সময়ে মাদকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল কেবল ধনিক শ্রেণির লোকদের এবং তা সাধারণের মাঝে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও ছিল কম। ইংরেজ আমলে মাদকের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন ৪৭-এ দেশভাগের পর নানা সময়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে শুরু করে। এরপর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে বিভিন্ন সময়ে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা হয়। সরকারের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও মাদকের বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। তাই জাতিকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে বাঁচাতে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। মাদকের সহজলভ্যতাসহ যে কারণগুলো দেশে মাদক বিস্তারের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সীমান্ত এলাকা এবং যে পথগুলো দিয়ে মাদক আসে সে পথে নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে মাদকের সঙ্গে সম্পর্কিত মামলাগুলো দ্রম্নত নিষ্পত্তি করার মাধ্যমে ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া কিশোর-কিশোরী এবং অভিভাবকসহ সবার মাঝে মাদকের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, এর কুফল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত মাদকবিরোধী সভা, সেমিনার,র্ যালির আয়োজন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে গণমাধ্যমে একাধারে গণসচেতনতামূলক ভিডিও বার্তা দিতে হবে। তাছাড়া সামজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেও নতুন প্রজন্ম নিজেদের মাদক থেকে দূরে রাখতে পারে। একটা দেশের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে সে দেশের যুবসমাজ। আর জাতি ধ্বংসে যুবসমাজকে মাদক দিয়ে যে আক্রমণ করা হচ্ছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কিশোর-তরুণদের মাদক থেকে দূরে রাখতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেক সুনাগরিকের উচিত তাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। সর্বোপরি সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা এবং দেশপ্রেম জাগ্রত করার মাধ্যমে জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর এখনই সময়।

অমিত হাসান

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ

ঢাকা কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে