শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি

নতুনধারা
  ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

মহাসড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার শতকরা ৮০ ভাগ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। মহাসড়কে একই মানের গাড়ি, কাজেই একটি গাড়ির আরেকটি ওভারটেক করার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। অথচ আমরা দেখতে পাই পেছনের গাড়ি সামনের গাড়িটিকে ওভারটেক না করা পর্যন্ত যেন স্বস্তি পায় না। আমাদের দেশের চালকদের এটা একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা প্রয়োজন।

নতুন আইনের বিধি-বিধানগুলো-

১. নতুন আইনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে শাস্তির বিধান। এই অপরাধে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষের মৃতু্য হয়েছে তদন্তে প্রমাণিত হলে ফৌজদারি আইনের ৩০২ ধারায় মামলা স্থানান্তর হবে। অর্থাৎ মৃতু্যদন্ডের সুযোগ থাকছে। এই ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য। পুরনো আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদন্ড এবং এটি জামিনযোগ্য অপরাধ ছিল।

২. যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে নিবন্ধন সনদ না নিয়ে রাস্তায় যানবাহন নামালে এর মালিককে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ড ভোগ করতে হবে। ভুয়া নম্বরপেস্নট দিয়ে যানবাহন চালালে সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

৩. সরকারের কার্যকর করা এ নতুন আইনে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে এক মাসের কারাদন্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

৪. নতুন এ আইনে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাসের জেল অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। অথবা উভয় দন্ড হতে পারে। তা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে অষ্টম শ্রেণি পাস করতে হবে।

৫. ভাড়ার তালিকা নিয়ে অবহেলা নয়, গণপরিবহণে বাড়তি ভাড়া আদায় নৈমিত্তিক ব্যাপার। ভাড়ার তালিকা না থাকলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা এক মাসের কারাদন্ড- অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। একই সঙ্গে এটি চালকের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তার এক পয়েন্ট কাটা যাবে।

৬. ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাবে ভাড়ার মিটার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। তবে এসব যানের প্রায় কোনোটারই মিটার সচল নেই। থাকলেও মিটার মেনে যাত্রী বহন করে না। আগের আইনে এর জন্য কোনো শাস্তির বিধান ছিল না। এখন মিটার বিকল থাকলে এবং যে কোনো গন্তব্যে যাত্রী পরিবহণে অস্বীকৃতি জানালে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডের ব্যবস্থা আছে।

৭. যানবাহনচালককে যেমন সংকেত মেনে চলতে হবে, তেমনি পথচারীকে সড়ক-মহাসড়কে জেব্রা ক্রসিং, পথচারী-সেতু, পাতালপথসহ নির্ধারিত স্থান দিয়ে পার হতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে চালক ও পথচারীকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডে পড়তে হবে।

৮. যত্রতত্র হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর অপরাধে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। নতুন আইনে এ অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা তিন মাসের কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডের মুখোমুখি হতে হবে।

৯. কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা তিন মাসের কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। সরকার নির্ধারিত স্থানের বাইরে গাড়ি পার্কিং করলে বা যাত্রী-মালামাল ওঠানামার দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার সুযোগ আছে।

১০. দেশের পরিবহন্ড খাত থেকে বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আছে। চাঁদাবাজির বিষয়টি আগের আইনে উপেক্ষিত ছিল। এবার ফৌজদারি আইনের ১৭ ধারায় শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় চাঁদাবাজির দায়ে সর্বোচ্চ তিন বছরের শাস্তির বিধান রয়েছে।

এই আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম প্রশংসনীয়, তবে সরকারের গৃহিত এ সব উদ্যোগের কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

সড়ক দুর্ঘটনা সবার কাছে এক আতঙ্কের নাম। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ হতাহত হচ্ছে। সড়কের মড়কে খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের কোল। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমান সময়ে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, যা বেদনাদায়ক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। সরকারের একার পক্ষে সড়ক দুর্ঘনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সড়ক দুর্ঘনা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

উলেস্নখ্য, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন ২০১৮ তারিখে ছয়টি নির্দেশনা এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আরও ১৭টি নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজ পর্যন্ত এ সব নির্দেশনার কার্যকর বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়নি। এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর ছয়টি নির্দেশনা হলো-

গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, লং ড্রাইভের সময় বিকল্প চালক রাখা, যাতে পাঁচঘণ্টার বেশি কোনো চালককে একটানা দূরপালস্নার গাড়ি চালাতে না হয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা। সড়কে যাতে সবাই সিগন্যাল মেনে চলে- তা নিশ্চিত করা। পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ ছাড়া ১৬ আগস্ট ২০১৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নবিষয়ক এক সভায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৭টি নির্দেশনা প্রদান করা হয়। নির্দেশনাগুলোহলো-

১. ঢাকা শহরে চলমান সব গণপরিবহণ, শহরে চলাকালে সব সময় দরজা বন্ধ রাখা এবং বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা নিশ্চিত করতে বিআরটিএ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

২. একই সময়ের মধ্যে গণপরিবহণে (বিশেষত বাসে) দৃশ্যমান দু'টি স্থানে চালক এবং হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করা।

৩. সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে (সর্বোচ্চ দু'জন আরোহী) বাধ্যতামূলক হেলমেট পরিধান এবং সিগনালসহ সব ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা।

৪. সব সড়কে বিশেষত মহাসড়কে চলমান সব পরিবহণে (বিশেষত দূর পালস্নার বাসে) চালক এবং যাত্রীর সিট বেল্ট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া এবং পরিবহণগুলোকে সিট বেল্ট সংযোজনের নির্দেশনা দেওয়া এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।

৫. ঢাকা শহরের যে সব স্থানে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে সে সব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। প্রয়োজনে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকদের ধন্যবাদ কিংবা প্রশংসাসূচক সম্বোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

৬. ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসগুলোয় প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্ডারপাসগুলোয় প্রয়োজনীয় লাইট, সিসিটিভি স্থাপনাগুলো ব্যবহার করা।

৭. ঢাকা শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং ও রোড সাইন দৃশ্যমান করা, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, অবৈধ পার্কিং এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করা, সব সড়কের নাম ফলক দৃশ্যমান স্থানে সংযোজনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

৮. ট্রাফিক সপ্তাহে চলমান সব কার্যক্রমগুলো পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত যথাসম্ভব অব্যাহত রাখা।

৯. স্বয়ংক্রিয় বৈদু্যৎতিক সিগনাল ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১০. একই সময়ে ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদু্যতিক সিগনালিং পদ্ধতি চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১১. ঢাকা শহরের সব সড়কের রোড ডিভাইডারের উচ্চতা বৃদ্ধি করে বা স্থানের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।

১২. মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত (আপ এবং ডাউনে) নূ্যনতম দু'টি স্থানে স্থায়ী মোবাইল কোর্ট বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং প্রতিনিয়ত দৈব চয়নের ভিত্তিতে যানবাহনের ফিটনেস এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা। শহরের অন্যসব স্থানেও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী অস্থায়ীভাবে অনুরূপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

১৩. ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি বা শুরু হওয়ার সময় অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, স্কাউট এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারের উদ্যোগ নিতে হবে।

১৪. অবৈধ পরিবহণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ফিটনেস দেওয়ার প্রক্রিয়াতে অবশ্যই পরিবহণ দেখে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নিতে হবে।

১৫. রুট পারমিট/ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোকে দ্রম্নত ধ্বংস করার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে।

১৬. লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে 'লারনার' দেওয়ার প্রাক্কালে ড্রাইভিং টেস্ট নেওয়া যেতে পারে এবং উত্তীর্ণদের দ্রম্নততম সময়ে লাইসেন্স দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৭. কর্মকর্তা/কর্মচারীর ঘাটতি থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

উপরোক্ত নির্দেশনাগুলোসহ পরিবহণ আইন ২০১৮-এর কার্যকর বাস্তবায়ন হলে সড়ক দুর্ঘটনা নিশ্চিত কমে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালক যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

লায়ন গনি মিয়া বাবুল

নির্বাহী সদস্য ও সাবেক যুগ্ম মহাসচিব

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), কেন্দ্রীয় কমিটি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে