বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

অসাম্প্রদায়িক চেতনা আজ কোথায়

নতুনধারা
  ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

'সাম্প্রদায়িকতা' হচ্ছে সম্প্রদায়ভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকান্ড। আমি যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সেটি বিশ্বে সবচেয়ে সেরা এবং আর সব সম্প্রদায় নিকৃষ্ট, এ ধারণায় বিশ্বাস স্থাপন। এরপর এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আমার সব কার্যপদ্ধতি পরিচালনা করা। যেহেতু অন্যেরা নিকৃষ্ট সেহেতু তাদের অধিকারও নূ্যনতম। ধনসম্পদ থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক সব সুযোগ-সুবিধাতে আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। এ বিশ্বাস ও কার্যকলাপের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে অন্যের ওপর চেপে বসা। হয় তারা আমার সম্প্রদায়ভুক্ত হবে নয়তো নিশ্চিহ্ন হবে।

'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটি ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে রয়েছে দুটি সম্প্রদায়, একটি আস্তিক যারা স্রষ্টা ও ধর্মীয় আচারে বিশ্বাস করে এবং অন্যটি নাস্তিক যারা এ সবে বিশ্বাস করে না। অবশ্য এ দুটোর মাঝামাঝি তৃতীয় আর একটি সম্প্রদায়ের কথা শোনা যায় যারা পুরোপুরি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করে না। আস্তিকের মধ্যে রয়েছে আরও কিছু উপবিভাগ। যেমন- মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি ইত্যাদি। অতএব, একই রক্ত-মাংসের মানুষ হলেও নিজস্ব বিদ্যা, বুদ্ধি, সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার এক স্বর্ণসময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধে। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব পেশার মানুষ এক জোট হয়ে আন্দোলন করেছে, যুদ্ধ করেছে। তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, আবার ধর্মহীনতাও ছিল না। একজন মানুষের প্রতি অন্য মানুষের এমন মমতা ও ভালোবাসা আর কখনো দেখা যায়নি। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা চেয়েছি সেরকম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সব পেশা ও ধর্মের মানুষ যদি এক হয়ে কাজ না করতে পারি তবে এ দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনীতির সাধনার মূলে অন্যতম আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদ। এ দুটি আদর্শে পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধও। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও সব ধর্মের মানুষের প্রতি ছিল তার সমান ভালোবাসা। তিনি নিজেই বলে গেছেন বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদাযয়িক দেশ। যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-ধারার মনোভাবের মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যে দেশে কখনোই সাম্প্রদায়িকতা মনোভাবের জন্ম হতে পারে না। একটি স্বাধীন দেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকল্প নেই।

বর্তমান বাংলাদেশেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লালনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, এর মূলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এর মূলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশের হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালি, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন তিনি।

মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআনে তো অমুসলিমদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে। আজ তাদের ভয়াবহতার শিকার যারা অন্য ধর্মের অনুসারী তারা, তাদের ঘর-বাড়ি পোড়ানো হলো, মন্দিরে আগুন দেওয়া হলো, প্রতিমা ভাঙা হলো, শুধু তাই-ই নয়- তারা মসজিদের ভেতরেও অরাজক পরিস্থিতির অবতারণা করেছে, কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে যার ইচ্ছে সে নিজেই ইসলাম হেফাজতের ভূমিকায় অভিনয় করছে আর যাকে ইচ্ছা তাকে নাস্তিক বলে অপবাদ দিচ্ছে, আমাকে নাস্তিক ট্যাগ দেওয়ার বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত বা জাপার কি অধিকার আছে? কি ধর্মের ভিত্তিতে, কি কাজের ভিত্তিতে? প্রসঙ্গক্রমে চলে আসছে- উপমহাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির কথা। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ধর্মীয় কতিপয় দল যেভাবে দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, ধর্মকে বিতর্কিত করেছিল অন্য কোনো দেশে তা করা হয়নি, যদিও বা দেশে প্রচুর বক ধার্মিক মনোভাবের ধর্মীয় দল আছে।

এভাবে হয় না, হতে দেওয়া যায় না, যদি হয়েও যায় তাহলে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কিচ্ছু থাকবে না, থাকবে না বাঙালির বীরত্বের ইতিহাস, যে জাতি বিশ্বের কাছে মাথা না নোয়াবার জন্য পরিচিত, যে জাতি পরিচিত সংগ্রামের জন্য, যে জাতি পরিচিত অধিকার আদায়ের শপথে ইস্পাত কঠিন মনোবলের জন্য, বিশ্বের মানচিত্রে আমরা অনন্য জাতি যারা ঘোষণা দিয়েই স্বাধীনতা আদায় করেছিল, যেটার পেছনে দলমত নির্বিশেষে সবার সমান অবদান ছিল। কিন্তু আজ কিছু উগ্রপন্থি দলের কারণে এত দিনের অর্জন নিভে যেতে পারে না। বাংলাদেশ ধর্মান্ধ দেশ হতে পারে না, হতে পারে না পাকিস্তান বা আফগানিস্তান।

আমরা সবাই অল্পবিস্তর সাম্প্রদায়িকতা লালন করছি। অসাম্প্রদায়িক হওয়াটা আসলেই সহজ কাজ নয়। যারা অশিক্ষিত ও দরিদ্র তারা বোধকরি বেশি অসাম্প্রদায়িক, কারণ তাদের স্বার্থচিন্তা ততটা প্রকট নয়। অল্পতে যারা তুষ্ট থাকে তারা কখনো অন্যের ওপর চড়াও হয় না সহজে। বিত্তবানরাই ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় সবার মধ্যে নিজের স্বার্থে। আর শাসকগোষ্ঠী তো চিরকালই শোষকের ভূমিকা পালন করেছে, কখনো সেবক হতে পারেনি। তাই সাম্প্রদায়িকতা তাদের কাছে এক মোক্ষম অস্ত্র। এ অস্ত্রের ব্যবহার আমরা যুগে যুগে দেশে দেশে দেখেছি, এখনো দেখছি।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার এক স্বর্ণসময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধে। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব পেশার মানুষ এক জোট হয়ে আন্দোলন করেছে, যুদ্ধ করেছে। তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, আবার ধর্মহীনতাও ছিল না। একজন মানুষের প্রতি অন্য মানুষের এমন মমতা ও ভালোবাসা আর কখনো দেখা যায়নি। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা চেয়েছি সেরকম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সব পেশা ও ধর্মের মানুষ যদি এক হয়ে কাজ না করতে পারি তবে এ দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সবার সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের প্রয়োজন।

প্রসেনজিৎ কুমার রোহিত

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে