বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

ধর্মীয় সম্প্রীতির গৌরব অক্ষুণ্ন থাকুক

নতুনধারা
  ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

বিশ্ব মানচিত্রের বুকে চিরসবুজ, চোখ জুড়ানো ও হৃদয় প্রশান্ত করা ছোট্ট শ্যামল ভূখন্ড আমাদের বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের এই অংশের রয়েছে আলাদা ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নিজস্ব সংস্কৃতি পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলো যেখানে ধর্মীয় বিভাজনে অশান্তির আগুনে পুড়ে মরে; তখনও এই দেশ হাজারও নজির স্থাপন করে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় কারণে দেশভাগ হলেও বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে ধর্মীয় পরিচয় কারও জন্য বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে মহামারি করোনাকালে মুসলিম কর্তৃক হিন্দুর সৎকারের দৃশ্য যেমন রয়েছে তেমনি হিন্দু কর্তৃক মুসলিমদের জন্যও উদার হাত প্রসারণের নজিরও আছে। হাতেগোনা কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল বোঝাবুঝি কিংবা দুর্ঘটনা ছাড়া এ দেশে নিছক ধর্মীয় কারণে কখনো দাঙ্গা দেখা যায়নি। যতটুকুই ঘটেছে পরে এসবের পেছনে ব্যক্তিগত শত্রম্নতা কিংবা স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে তৃতীয়পক্ষের যোগসাজস মিলেছে অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রেই। এই কথাগুলো যে কোনো বিবেকবান হিন্দু কিংবা মুসলিম স্বীকার করবেন অবলীলায়। যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের এমন বন্ধন বিশ্বের বুকে এমন ধর্মীয় সম্প্রীতি সত্যিই বিরল। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৩ অক্টোবর কুমিলস্নার একটি পূজামন্ডপে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার জন্য প্রস্তুতকৃত মূর্তির পায়ের তলে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনা ও তৎপরবর্তী ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দেশের বিবেকবান মানুষ কষ্টই পাচ্ছে না, রীতিমতো ভাবিয়েও তুলছে! হঠাৎ করেই সম্প্রীতির দেশে কী হচ্ছে এ সব! ধর্মীয় অস্থিরতা সম্প্রীতির সংকটই সৃষ্টি করে না, বরং দেশপ্রেমিক নাগরিকরা এ সবকে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পরোক্ষ আঘাত বলেই মনে করেন। দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে কখনোই এমন অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখতে আমরা প্রস্তুত নই। কিন্তু এ সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে কারা জড়িত? সেটা যে বা যারাই হোক, তারা যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাংলাদেশের অনুপম ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হোক সেটি দেশের ভেতর কিংবা ভিনদেশি কোনো শক্তি। কারণ একজন সত্যিকার হিন্দু কখনোই কোরআনের অবমাননা কিংবা মসজিদে হামলা করতে পারে না। হিন্দু ধর্ম তা শিখায় না। আবার একজন খাঁটি মুসলিম কখনোই মন্দির কিংবা মূর্তির গায়ে হাত তুলতে পারে না। কারণ ইসলাম অন্য ধর্ম পালনে প্রহরীর ভূমিকায় থাকার সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়। দেশে আজ যা হচ্ছে, ধর্মীয় সংবেদনশীলতাপূর্ণ বিষয়ে আঘাত করে এ সব বিশৃঙ্খলা যে সুপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। কারণ কোনো ধর্মই অন্য ধর্মগ্রন্থের অবমাননার কথা তো বলেই না, বরং তা সব ধর্মেই সমানভাবে নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। সুতরাং এ সব গর্হিত কাজ করা কোনো হিন্দু ধার্মিকের দ্বারা করা অসম্ভব। একইভাবে অসম্ভব কোনো মুসলিম ধার্মিকের দ্বারা মন্দির কিংবা মূর্তিতে আঘাত করা। যারা ধর্মীয় সম্প্রীতির মূলে কুঠারাঘাত করছে তারা নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে শুধু অজ্ঞই নয়, বরং চরম গন্ডমূর্খ ও অসভ্য। তারা হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের শত্রম্ন। এ সব ধর্মবিদ্বেষী কালপ্রিটগুলোকে অতিসত্বর আইনের আওতায় আনা জরুরি। হোক সে নামধারী মুসলিম কিংবা নামধারী হিন্দু। এ সব উগ্র ও অধার্মিক মানুষরূপী পশুগুলোকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে প্রশাসনকে দ্রম্নত সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সুতরাং এ দেশে সব ধর্মের মানুষ সমান মানদন্ডে একই ক্যাটাগরির বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে ধর্ম এখানে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। সমান অধিকার এখানে সংরক্ষিত। ধর্মীয় ইসু্যতে হোক কিংবা অন্যকোনো অধিকার আদায়ের ব্যাপারে হোক বাক্‌স্বাধীনতা ও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ যেমন নাগরিক অধিকার, তেমনি ধর্মীয় সহনশীলতা ও অপরাপর ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাবের সঙ্গে সহাবস্থান সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার প্রথম শর্ত। সুতরাং যে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ফলে ক্ষোভ-বিক্ষোভে রক্তপাত মেনে নেওয়া যায় না। সর্বধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনগুলোকে আজ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে দেশের টানে। যেহেতু কোনো প্রকৃত হিন্দু মূর্তির পায়ের তলে পবিত্র কোরআন রেখে অবমাননা করেনি, মসজিদে হামলা করেনি। কোনো প্রকৃত মুসলমানও মূর্তি কিংবা মন্দিরে আঘাত করেনি, যেহেতু দেশের প্রকৃত আলেম কিংবা সত্যিকার পুরোহিত এ সব কর্মকান্ডকে চরমভাবে ঘৃণা করেন। সেহেতু ধর্মের প্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে তুলতে আজ কোনো বাধা নেই?

তবে যারা এসব ঘৃণ্যকান্ড ঘটিয়েছে তারা ধর্মসন্ত্রাসী। ধর্মের মোড়কে অধর্মের বিষ ছড়িয়ে দেওয়াই তাদের কাজ। তাদের সামাজিকভাবে বয়কট ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিহত করতে হবে। সময় এসেছে মসজিদের ইমাম সাহেবদের নেতৃত্বে অন্যধর্মের উপাসনালয় ও উপাসকদের নিরাপত্তায় আপামর মুসলিম জনতাকে প্রহরীর ভূমিকা পালন করার। সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনে অবাধ বিচরণের পথ সৃষ্টি করে দেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠদের উপর গুরুদায়িত্বও বটে। তবে এ সব উগ্র-উন্মাদদের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়িয়ে চিরধর্মীয় সম্প্রীতির বাংলাদেশে অশান্তির বীজ বুনে দিতে চায়, এ দেশ থেকে তাদের সমূলে উপড়ে ফেলা হোক। আমরা সম্প্রীতির বাংলাদেশে ধর্মের বিষ দেখতে চাই না। বিশ্বের বুকে ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র আমার বাংলাদেশে এদের ঠাঁই নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এ সব বিষবাষ্প ছড়ানো নরাধমদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হোক- 'এরা ধর্মহীন'- অধার্মিক। এদের কোনো ধর্ম নেই। মূর্খতাই তাদের পরম ধর্ম।

আমাদের মনে রাখতে হবে- নিজ ধর্মের প্রতি যে যতটুকু অজ্ঞ, অন্য ধর্মের প্রতি সে ততটুকুই উগ্র। অজ্ঞতার কারণে সৃষ্ট উগ্রতা নিরসনে উভয় ধর্মের দায়িত্বশীলদের স্ব স্ব ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান সাধারণ মানুষের মধৌ ছড়িয়ে দেওয়ার বিকল্প নেই। ধর্মীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতার দরুণ অজ্ঞতার কারাগার থেকে মুক্তি না মিললে মানুষ অধর্মের প্রতি পা বাড়াবেই। সে জন্য স্বধর্মকে জানার পাশাপাশি অপরাপর ধর্মজ্ঞান মানুষের ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার দূর করবে। আন্তঃধর্মীয় জ্ঞান মানুষকে অপরাপর ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল করে তুলতেও সাহায্য করবে। স্ব স্ব ধর্মের উদারতাগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীতলতাও ধর্মীয় সম্প্রীতির সংকট নিরসনের মহৌষধ। সাম্যের একেকটি সুউচ্চ সৌধ হয়ে উঠুক আমাদের প্রাণের ধর্মগুলো। বাংলার জমিনে ধর্মীয় মোড়কের আবরণে মানুষে মানুষে রক্তপাত বন্ধ হোক। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে অন্ধকার নেমে না আসুক মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার বাংলাদেশে। আজ সারা বাংলায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্বরে আওয়াজ উঠুক- ধর্মীয় অজ্ঞতা নিপাত যাক, শান্তির সম্প্রীতি মুক্তি পাক।

জাতীয় কবির ভাষায় বলতে চাই-

\হ'মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান,

\হমুসলিম তার নয়ন, হিন্দু তাহার প্রাণ।

\হএক সে আকাশ মায়ের কোলে

\হএক সে নাড়ির টান,

\হমোরা হিন্দু মুসলমান,

\হমোরা হিন্দু মুসলমান।'

\হ

তৌহিদ বিলস্নাহ

পলাশ, নরসিংদী?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে