শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এ অবস্থান অন্যান্য ক্ষেত্রেও নেয়া দরকার

বাংলাদেশ ভারতের বড় বাজার। ভারতের হেন কোনো পণ্য নেই যা বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশাধিকার অবারিত বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশে বাধার শেষ নেই। ট্যারিফ, ননট্যারিফ, অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্কসহ নানা কৌশল ও নামে আরোপিত শুল্কের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ আটকায়। যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডবিস্নউটিও)'র নীতিমালা পরিপন্থি। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের চেষ্টায়ও বাংলাদেশের তেমন একটা সফলতা নেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রতিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়মে বাংলাদেশ চাইতে পারে, চাওয়া উচিতও।
জহির চৌধুরী
  ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

ভারত নিজের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য যে উপকূলীয় ভিত্তিরেখা বা বেসলাইন ব্যবহার করছে, এর একটি অংশ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পড়েছে দাবি করে বাংলাদেশ বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা দীর্ঘ ৭ বছর চালিয়ে যাচ্ছে। ফলপ্রসূ হয়নি। বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সমাধানের জন্য বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে বাংলােেদশ। চিঠিতে বাংলাদেশ উলেস্নখ করেছে, 'দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে জানায়নি। কিন্তু এখন বাংলাদেশ পরিষ্কারভাবে ভারতের এ অবস্থানের বিরোধিতা করছে। ভারত বিষয়টি সুরাহা করে জাতিসংঘকে অবহিত না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ এ বিরোধিতা করতে থাকবে।' এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম একটি জাতীয় দৈনিকে বলেছেন, 'ভারত যেভাবে বেসলাইন নির্ধারণ করেছে, সেটি আনক্লজের ৭ নম্বর ধারার পরিপন্থি। তাই আমরা এ নিয়ে আপত্তি তুলে ধরেছি।'

কোনো দেশের সঙ্গে কোনো দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়- ক্ষেত্রে বিরোধ থাকতেই পারে। সে বিরোধের সুরাহা-সমাধান দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় হতেও পারে, নাও পারে। বিরোধের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সুরাহা হলে উত্তম, না হলে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ভারতের নির্ধারিত বেসলাইন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পড়েছে দাবি করে বাংলাদেশ বিষয়টি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা ৭ বছর ধরে করে আসছে। বাংলাদেশের ৭ বছরের চেষ্টা সফল হয়নি। এমতাবস্থায় বিষয়টির সুরাহার জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের উপায় ছিল না। দুটি বন্ধু দেশের বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পথই বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মিটিয়েছে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের মাধ্যমে। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ। বিভিন্ন বিষয়- ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের এমন কিছু সমস্যা-বিরোধ রয়েছে যেগুলোর সুরাহা দু'দেশ দশকের পর দশক আলোচনা করেও শেষ করতে পারেনি। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা অপসারণসহ কয়েকটি ক্ষেত্রের বিরাজমান বিরোধ/সমস্যা সুরাহার চেষ্টা দশকের পর দশক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি। যুগ-যুগ ধরে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সুরাহা না হওয়া বিরোধ/সমস্যাগুলোর সুরাহা বাংলাদেশের জন্য জরুরি। দীর্ঘদিনের আলোচনায় সমাধান না হওয়া সমস্যাগুলোর সুরাহার প্রয়োজনে বাংলাদেশ নির্ধারিত আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে যাওয়ার সুযোগ আছে, সে সুযোগ কাজে লাগানো দরকার দেশ-জাতির স্বার্থে।

\হভারত ও বাংলাদেশের মধ্য বহমান অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী। আন্তর্জাতিক নদী স্বীকৃত নদীর পানির ওপর কোনো দেশের একচ্ছত্র বা একচেটিয়া অধিকার থাকে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি কোনো দেশের একতরফাভাবে প্রত্যাহার, নদীতে বাঁধ নির্মাণ কিংবা নদীর গতিপথ পরিবর্তন আন্তর্জাতিক নদী আইনের পরিপন্থি। আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহার সংক্রান্ত হেলসিংকি নীতিমালা বিশ্বের প্রায় সব দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য। হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ, অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এ জন্য অবশ্যই অন্য দেশের যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এ নীতিমালার ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'অববাহিকাভুক্ত একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অববাহিকায় প্রবাহিত পানির ব্যবহার সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপ অবহিত করবে।' ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে গৃহীত আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশনের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ থেকে পানি ব্যবহারের সময় পার্শ্ববর্তী একই অববাহিকার অন্যান্য দেশের যাতে বড় ধরনের ক্ষতি না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।' ভারত বাংলাদেশ অভিমুখী ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টিরই পানি এক তরফাভাবে প্রত্যাহার করছে। ভারতের এক তরফাভাবে অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ সংক্রান্ত আইন, নীতিমালার সুস্পষ্ট লংঘন। ভারত অভিন্ন নদীর পানি এক তরফাভাবে প্রত্যাহার করে নদীর দেশ বাংলাদেশকে ইতোমধ্যেই বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে, এভাবে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকবে না। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। খুব একটা লাভ হচ্ছে না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা তাও ভারত দেওয়া না। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ভারতের কাছ থেকে আলোচনার মাধ্যমে আদায়ের আশা করা যায় না। অভিন্ন নদীর পানির হক আদায়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)'র নির্বিচারে নিরীহ বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বহু বৈঠক, দেন-দরবার করেছে। কোনো ফল নেই। কোনো দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিএসএফের মতো প্রতিবেশী দেশের নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নির্বিচারে হত্যার নজির নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমারের স্থল সীমান্ত রয়েছে। ওইসব সীমান্তে বিএসএফ দেশগুলোর বেসামরিক নাগরিক হত্যা করতে দেখা যায় না। পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফ বন্দুকের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে দায়িত্ব পালন করে। সে সীমান্তেও বিএসএফ বেসামরিক নাগরিক হত্যা থেকে বিরত থাকে সচেতনভাবে। সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জেরই শামিল। সীমান্ত হত্যা বন্ধে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরি।

বাংলাদেশ ভারতের বড় বাজার। ভারতের হেন কোনো পণ্য নেই যা বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশাধিকার অবারিত বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশে বাধার শেষ নেই। ট্যারিফ, ননট্যারিফ, অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্কসহ নানা কৌশল ও নামে আরোপিত শুল্কের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ আটকায়। যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডবিস্নউটিও)'র নীতিমালা পরিপন্থি। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের চেষ্টায়ও বাংলাদেশের তেমন একটা সফলতা নেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রতিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়মে বাংলাদেশ চাইতে পারে, চাওয়া উচিতও।

ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশের জন্য অতীব জরুরি এমন সমস্যাগুলোর বেশিরভাগই সমাধান হয়নি। সমস্যাগুলোর সমাধান না হওয়ায় বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে যে সমস্যাগুলোর সমাধান দীর্ঘদিনের আলোচনায় সুরাহা করা সম্ভব হয়নি, সমাধান আন্তর্জাতিক ফোরামের সহযোগিতায় সম্ভব- সেগুলোর সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার পদক্ষেপ আর দেরি না করে নেয়া দরকার। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়ে সফল হয়েছে। অন্যান্য সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও একই পথ ধরতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। সার্বভৌম দেশ যেকোনো দেশের কাছ থেকে হক আদায়, বিদ্যমান বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। ভারতের নির্ধারিত বেসলাইনে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ন্যায় সঙ্গত সমাধানের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের এ অবস্থান সার্বভৌম দেশের অবস্থান; এটাই হওয়া উচিত সার্বভৌম দেশের অবস্থান। এ অবস্থান অন্য ক্ষেত্রেও দরকার।

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

পযড়ফিযঁৎুুধযরৎ@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে