অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

আওয়ামী লীগের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চাওয়া আছে, একাত্তরের চাওয়া-পাওয়া আছে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মৌলিকত্বের চাওয়া আছে, এ দেশের প্রগতিশীল সচেতন আধুনিক মানুষ এখনো মনে-প্রাণে চায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, আওয়ামী লীগকে তারা ভরসা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকাবস্থায় যদি কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্ণীপুর, নোয়াখালীসহ দুই ডজন জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, লোকশিল্পী এবং বাউলশিল্পীর উপর আঘাত আসে, বিচার না হয় এবং সর্বত্র প্রতিক্রিয়াশীলদের তীব্র আস্ফালন হয় তখন ভরসার জায়গাটা থাকে না, নড়বড়ে হয়ে যায়।

প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

অরিত্র দাস
গণতন্ত্রের জন্য যে যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতার বলয় থেকে মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ, বৈষম্যের করাঘাত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে যুদ্ধ, সর্বোপরি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতীয়তাবোধের জন্য যে যুদ্ধ আজ সেই যুদ্ধের মহিমা কতটুকু প্রজ্বলিত হচ্ছে? যুদ্ধের পরক্ষণেই স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে প্রতিটি স্তরে। একাত্তরের পর এই দেশে গণতন্ত্র নিয়ে বারবার টানাহেঁচড়া হয়েছে, দীর্ঘকাল এখানে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। কোনো দলই গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। গণতন্ত্রের নামে সব সরকারই একনায়কতন্ত্রের চর্চা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। হিন্দু মুসলমানের শ্রেণি বিভাজন কমেনি, বরং বেড়েছে। নিজেদের গদি সামলাতে গিয়ে মৌলবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করেছে, মেনে নিয়েছে সংকীর্ণবাদীদের দাবি-দাওয়া। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মৌলিক ও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আদর্শের চর্চা কেউ করেনি। যা করেছে তা কেবল মুখে মুখে, রাষ্ট্রীয় কাগজে-কলমে রয়েছে কিন্তু চর্চা হয়নি। ফলে গত কয়েক দশকে মানবিক তারুণ্য তৈরি হয়নি। যা ছিল ৭১-এর আগেই...। সংখ্যাগত দিক থেকে এখন সুষম, অসাম্প্রদায়িক, সংবেদনশীল ও সচেতন শিক্ষিত বাঙালি মনন জগতের এক বিশাল অংশের মানুষের চিন্তা-ভাবনা খুবই সংকুচিত হয়ে গেছে। ভোগবাদী ও ধর্মের অপব্যবহারকারী হয়ে গেছে। এ দেশে প্রতিক্রিয়াশীল সংকীর্ণমনা ও সাম্প্রদায়িক উগ্ররা যে এখন থিয়েটার করে, সিনেমা করে, গান করে, শিল্প করে, সাংস্কৃতিক সংগঠন করে, অভিনয় করে, সাংবাদিকতা করে, কবিতা লেখে, উপন্যাস লেখে, প্রবন্ধ লেখে, শিক্ষকতা করে, নাচ করে, বাম করে, ডান করে- তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে যেন। দেশজুড়ে এত বড় সাম্প্রদায়িক হামলায় যাদের প্রতিবাদ নেই, সহমর্মিতা নেই তারা আর যাই হোক তাদের বাঙালি বলা যায় কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সবাই বাঙালি নয়, কেউ কেউ বাঙালি; যারা বাঙালিত্ব ধারণ করে ধর্ম ও কর্মে। বাকিরা উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবোধে বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়িক। কারণ অধিকাংশ প্রতিবাদ কেবল আক্রান্তের পক্ষ থেকেই দেখা যায়, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর কাছ থেকে আশানুরূপ দেখা যায় না, প্রায় নিশ্চুপই বলা চলে। তখন আস্থার প্রত্যেকটি খুঁটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। সাম্প্রদায়িকতা করে থাকে তিন শ্রেণি, এক- যারা পর্দার আড়ালে থেকে উস্কানি দেয় এবং উদ্বুদ্ধ করে। দুই- মাঠপর্যায়ে সক্রিয় থেকে যারা হামলায় অংশ নেয় এবং তিন- যারা মৌন থাকে অর্থাৎ বাড়িতে বসে মনে মনে এ ধরনের হামলায় খুশি হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়। এ তিন পক্ষ মিলে এদের পালস্না বিশাল! বিশাল বলতে অত্যাধিক বিশাল। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের একটানা চলমান ১৫ বছরে ১৫টা প্রজন্ম তৈরি করা যেত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, প্রগতিলব্ধ জ্ঞানচর্চায়; যারা হতে পারত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উদার আধুনিক মননশীলতার অধিকারী। বাস্তবায়ন করা যেত সেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো যা ছিল একাত্তরের অঙ্গীকার, যদি ইচ্ছাশক্তি থাকত। কিন্তু হয়নি, হয়েছে ভিন্ন...! রাষ্ট্র দিন দিন রক্ষণশীল তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা, অতপর এ সব সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যার বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাই যেন বলছে এখন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিগত ৯ বছরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায়- সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৬৭৯টি। বাড়িঘর ভাঙচুর ১ হাজার ৫৫৯টি। প্রতিমা, পূজামন্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর, আগুন ১ হাজার ৬৭৮টি। আহত হয়েছে ৮৬২ জন এবং নিহত হয়েছে ১১ জন। আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যারা আওয়ামী লীগকে আশ্রয় করে সংবিধান এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই সুযোগটির সৃষ্টি হয়েছে কারণ প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে ক্রমাগত কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে, এতে তারা সাহস পেয়েছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্রের জন্ম, সেই রাষ্ট্রের মৃতু্যও উক্ত দলের হাতে অনিবার্য হয়ে পড়বে। তা ছাড়া দেশের সামগ্রিক যা পরিস্থিতি তাতে আপতদৃষ্টিতে মনে হয়- এখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফেয়ার ইলেকশন দিলে জাকসু, ডাকসু, রাকসু, চাকসুসহ ছাত্র-সংসদগুলোয় প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র নেতারা বিপুল ভোটে জয়ী হবে! জাতীয় রাজনীতিতে ফেয়ার ইলেকশন দিলে প্রতিক্রিয়াশীলরা সিংহভাগ আসন তো পাবেই, আওয়ামী লীগ এক-তৃতীয়াংশ আসন ছিনিয়ে আনতে পারবে কিনা- একটা সন্দেহ রয়ে যায়! দেড় দশক মক্তিযুদ্ধের দল ক্ষমতায় থাকার পরও এমনটা আশা করা যায় না, কিন্তু হচ্ছে! বর্তমান আওয়ামী লীগ নিয়ে আমি শঙ্কিত! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় দীর্ঘ সময় থেকেও ৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে পারেনি! আওয়ামী লীগের সময়ই এক কঠিন পরিবেশ প্রতীয়মান হচ্ছে দিন দিন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৭২-এর সংবিধানে উলিস্নখিত যে চেতনার কথা বলা হয়, তা যদি আওয়ামী লীগ এখনো কিংবা আগামীতে প্রতিষ্ঠা না করে, তাহলে আওয়ামী লীগ নিজেই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বস্তুত মৌলিক আদর্শের যথার্থ বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া এভাবে বেশি দিন থাকা যায় না, থাকা যাবে তখনই যখন তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করা হয়। এ জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ কী- আওয়ামী লীগও ৭২ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসতে বাধ্য হবে, কেন আসবে? কারণ- একটা রাষ্ট্রের সিংহভাগ জনগণ যে আদর্শ লালন করে, প্রত্যাহিক জীবনে ধারণ করতে শুরু করে; তখন দল ক্ষমতা বা অস্তিত্বে থাকতে হলে- সেই আদর্শেই উজ্জীবিত হতে হয় নয়তো উক্ত দল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যায়। বিপদে পড়লে বুড়া গরুও পুল পার হয়। কিন্তু একটা সন্দেহ অবশ্য রয়েই যায়- স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ যদি প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোকে সমর্থন করে, তাদের দাবি-আদর্শ সমীহ করে রাষ্ট্র পরিচালনা কিংবা বিনির্মাণ করে: তাহলেও কি আওয়ামী লীগকে তারা মেনে নেবে? মেনে নেবে না। এখানকার রক্ষণশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল দল ও দলের অনুসারীরা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে কুণ্ঠিত হয়। কখনো মেনে নেয়নি। শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে চায় না- এ কথা তো সর্বজনবিদিত। যতদিন এ দেশ অসাম্প্রদায়িকতা আছে, বহু জাতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন আছে ততদিন আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আছে। আওয়ামী লীগ যদি তা ভুলে গিয়ে থাকে বা ভবিষ্যতে ভুলে যায়, ঠিক তখন থেকেই এ দলটির স্বাতন্ত্র্য বলতে আর কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে হয় আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে বসবে নয়তো নব্য আওয়ামী লীগার কর্তৃক তীব্র আওয়ামীবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করা হবে। খসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ঝুলে থাকবে- আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকায় খচিত চারটি তারকার একটি তারকা- ধর্মনিরপেক্ষতা, যা বঙ্গবন্ধুর দল তথা আধুনিক বিশ্বের উষালগ্নে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। অতীতে বাঙালি আচার-আচরণ যা ছিল তা এ সময়ে এসে হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা চলে- জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সাংস্কৃতিক চর্চা বা প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট প্রতিষ্ঠান বেশি গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। অসাম্প্রদায়িক বিদ্যাচর্চা বা বিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেবল মুখে মুখে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর একটু স্পষ্ট করে বলি- আপনি গাছ লাগাবেন নিমগাছ, আর ফল চাইবেন পাঁকা আম, তা কী করে সম্ভব? সারা বছর সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ করে, বাঙালির উৎসব-পার্বণের দিন অসাম্প্রদায়িক আচরণ আশা করা কেবল অপ্রাসঙ্গিক নয়, বোকামিও বটে। এই যে প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ তা যে শুধু সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে হয়, এমনটি কিন্তু নয়, বাঙালি বর্ষবরণ থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব পালনের বেলাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের দিন উগ্রপন্থিদের হামলার ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ পরিবেশ একদিনে তৈরি হয়নি। বহু বছর ধরে বিদ্বেষের চাষাবাদ হয়েছে, তার ফসল এটি। পঁচাত্তরের পরে বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে অবাধে সাম্প্রদায়িক আলাপ, সংকীর্ণ বিদ্যা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে অপসংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্যাদানের যত প্রতিষ্ঠান যত সংগঠন রয়েছে এবং নিত্য-নতুন গড়ে উঠছে; সেই তুলনায় কি অসাম্প্রদায়িক আদর্শ চর্চার প্রতিষ্ঠান আছে? উহু.. বোধহয় নেই। প্রোগ্রেসিভ সমাজ বিনির্মাণের অন্তরায় উগ্রবাদ। উগ্রবাদ রুখতে ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই কিন্তু দিন দিন বাংলাদেশে তারই অনুপস্থিতি বড় প্রস্ফুুটিত হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে যাত্রাপালা উঠে গেছে। ছোট ছোট সাহিত্য পত্রিকা, বিজ্ঞান পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও দেয়াল পত্রিকা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। একাধিকবার আক্রমণ হয়েছে লোকগীতির উপর, আবহমান বাংলার সংস্কৃতির উপর, হামলা হয়েছে শিল্পীর উপর, কোনো বিচার হয়নি বরং ধর্মানুভূতির প্রশ্নে শিল্পীকে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে কারাগারে। ফলে কবিগান, জারিগান, সারিগান, পুঁথিপাঠসহ অনেক ঐতিহ্যগত আচার-অনুষ্ঠান এখন চোখে পড়ে না। এক সময় মানুষ গাজীকালু রুস্তুম, জাদু প্রদর্শনী, সঙ, পালাগান বা মহুয়া পালা দেখে চিত্ত বিকশিত করত। নতুন কোনো সিনেমা, যাত্রা বা নাটকের আয়োজন করা হলে, সে সবের খবর মাইক বাজিয়ে প্রচার করা হতো গ্রাম-মহলস্নায়। সব হারিয়ে গিয়ে আজ সমাজ বিকৃত হয়ে নষ্ট হয়েছে। নাটমন্দির প্রথার কথা শোনা যায় না। সার্কাস শো, হাতি দিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি চাঁদা তোলা, পিঠা-উৎসব, বায়োস্কোপ- সে সব আজ কোথায়? চিড়িয়াখানায় নাকি জাদুঘরে? সেই জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে সাম্প্রদায়িক গুণকীর্তনের মঞ্চ। যেখান থেকে ধর্মীয় বিভাজনের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সাম্যের গান উপেক্ষা করে সংকীর্ণতার গান বাজানো হয়। ফলে ধর্মীয় বৈষম্য প্রকট হয়েছে, একপক্ষ অন্যায় করে পার পেয়ে যায়, অন্যপক্ষ কথিত ধর্ম অবমাননার গুজবে মার ও জেল খেটে যায়। সাহিত্যে একটা নিরপেক্ষ পরিবেশ নেই, যা অতীতে ছিল। সবকিছু ধর্মীয় মেরুকরণ। নাটক, সিনেমাগুলোতে অতিমাত্রায় ধর্মীয় সংস্কৃতি বিকাশ ঘটানো হয়েছে। শহরাঞ্চলে কিছুটা দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে সাহিত্য আড্ডা এবং লাইব্রেরিতে বই পড়ার প্রবণতা বিলুপ্ত প্রায়। পর্যাপ্ত গ্রন্থাগারই তো নেই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান অপাঠ্য হয়ে উঠেছে। উপরন্তু আজকাল রাত জেগে শরৎ বাবুর বই পড়ে কেউ অশ্রম্নসিক্ত নয়নে ঘুমাতে যায় না। সবার চোখে এখন অন্যকিছু- উগ্রতা। আপনাকে জাহির করার জন্য সমাজের নানা বিদ্বেষ, সহিংসতা। প্রেম-ভালোবাসা উদারতা ও মানবতা লোভ পেয়েছে। এভাবে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। একসময় বস্নাস্ট হয়ই.... বর্তমান প্রেক্ষাপট তারই প্রতিচ্ছবি! এর জন্য দরকার ছিল- মননশীলতার উন্নতি সাধন তথা তরুণদের উদার ও আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ভিত তৈরি করা যেমনটি জাপানে হচ্ছে। উদার অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ পাঠদান করাচ্ছে জাপানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে কখনোই তরুণ-তরুণীর মনস্তাত্ত্বিক ভিত তৈরি হয়নি, আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকেও হয়নি। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়, \হআওয়ামী লীগের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চাওয়া আছে, একাত্তরের চাওয়া-পাওয়া আছে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মৌলিকত্বের চাওয়া আছে, এ দেশের প্রগতিশীল সচেতন আধুনিক মানুষ এখনো মনে-প্রাণে চায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, আওয়ামী লীগকে তারা ভরসা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকাবস্থায় যদি কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্ণীপুর, নোয়াখালীসহ দুই ডজন জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, লোকশিল্পী এবং বাউলশিল্পীর উপর আঘাত আসে, বিচার না হয় এবং সর্বত্র প্রতিক্রিয়াশীলদের তীব্র আস্ফালন হয় তখন ভরসার জায়গাটা থাকে না, নড়বড়ে হয়ে যায়। যখন বাঙালি কৃষ্টিকালচার, বৈশাখের শোভাযাত্রা, বসন্তবরণ, নৌকাবাইচ বৌদ্ধদের উৎসব, খ্রিষ্টানদের বড়দিন, আদিবাসীদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, গ্রাম্যমেলা, মাসব্যাপী বিজয়মেলা পুলিশি পাহারা ছাড়া অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন এ রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক-শান্তির মানুষের দেশ বলা যেতে পারে, তার আগে বলার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? অরিত্র দাস : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট