কর ও করদাতা

বতর্মানে দেশের আয়কর নিধার্রণের যে ব্যবস্থাটা রয়েছে তার সংস্কার করাটা প্রয়োজন। প্রত্যক্ষ কর আর পরোক্ষ করের খাতগুলো আরও সুনিদির্ষ্ট করা দরকার। ভ্যাট নামে যে করটা আদায় হয় তা সম্পূণর্ পরোক্ষ কর। আদায়কৃত অথর্ কতটা সরকারের কোষাগারে জমা হয় তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

প্রকাশ | ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। এই ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ মানুষই কমর্ক্ষম। চিকিৎসাসহ স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০৩০ সালে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই হয়ে যাবে কমর্ক্ষম। বিবিসির পরিবেশিত এক সংবাদ তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছরই ১৮ লাখ মানুষ শ্রম বাজারে আসে। এই ১৮ লাখ জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রায় ৫ লাখ মানুষ শ্রম বিনিয়োগ করতে বিদেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশে বতর্মানে প্রতি বছর শ্রম বাজারে আসা কমর্ক্ষম (জনশক্তির ১৮-২৯ বছর বয়সী) শতকরা ৮০ ভাগই হলো উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পযর্ন্ত পড়াশুনা করা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, দেশের মোট কমর্ক্ষম জনশক্তির এক-চতুথার্ংশ বেকার, এরা কোনো কাজ পায় না। আর প্রায় এক-চতুথার্ংশের মতো আছে যারা কাজ পায়, তাও খÐকালীন। মোট কমর্ক্ষম জনশক্তির বিরাট একটা অংশ রয়েছে যারা পূণর্কালীন সময় শ্রম বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে এই অলস পড়ে থাকা শ্রমটা বাংলাদেশের অথর্নীতিতে কোনো কাজে লাগছে না। দেশের কর আদায়ের এবং করদাতার সংখ্যার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেশের মোট কমর্ক্ষম জনশিক্তর কত শতাংশ শ্রম বিনিয়োগ করতে পারে তার একটি চিত্রটা ফুটে উঠবে। দেশের বতর্মান সময়ের হিসাবে এ বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ প্রায় হবে। তাই বলা হচ্ছে ২০১৮-১৯ অথর্বছরে জিডিপি অজির্ত হবে ৭.৮ অথার্ৎ প্রায় ৮ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক ইকোনমিক প্রসপেক্টাসের মতে ২০১৮-২০২০ সালের অথর্বছরগুলোয় গড়ে ৬.৭ অথার্ৎ প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অজির্ত হবে। বাংলাদেশের জিপিডি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, লক্ষ করলে দেখা যায় প্রতি বছরই তার ইতিবাচক ২০১২-১৩ সালের জিপিডি ছিল ৬.০১ শতাংশ, ২০১৩-১৪ সালে তা দঁাড়ায় ৬.০৬ শতাংশ, ২০১৪-১৫ সালে তা হয় ৭.২৪ , ২০১৭-২০১৮ সালে দেশের জিডিপি ছিল ৭.৪০। এই ক্রমবধর্মান জিডিপিতে বোঝা যায়, দেশের এৎড়ংং উড়সবংঃরপ চৎড়ফঁপঃ বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডিপি বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এখন মাথাপিছু আয় ১৭৫১ ডলার। অথার্ৎ একজন মানুষ বছরে এখন ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৯ টাকা আয় করে। মাথাপিছু আয় কিন্তু কোনো একক ব্যক্তি আয় নয়। দেশের মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যে গড় পাওয়া যায় তা হলো মাথাপিছু আয়। বাংলাদেশের বতর্মান সাবির্ক অথর্নীতির অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, দেশের সামষ্টিক অথর্নীতি স্ফীত হচ্ছে। তাই বলা যাচ্ছে, বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে চলেছে। দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছে এটা ঠিকÑ এই মধ্যম আয়ের দেশের সুফলটা কজনের ভাগ্যে জুটছে তা এখন দেখার বিষয়। আমরা যদি দেশের করদাতার সংখ্যাটা বিশ্লেষণ করি তাহলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে কত শতাংশ মানুষ কর প্রদান করেন। ২০১৬-১৭ অথর্বছরের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে সেই সময় কর প্রদানকারীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখের মতো। ২০১৮-১৯ অথর্বছরে করদাতার সংখ্যা দঁাড়াবে প্রায় ১৫ লাখ। বিষয়টি হলো মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ এই করের আওতায় রয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায় .০০৮ শতাংশ মানুষ করের আওতায় আছে বা কর প্রদান করে। এতে প্রতীয়মান হয়, দেশের আয়বৈষম্যটা মারাত্মক। কারণ যদি চার সদস্যবিশিষ্ট্য পরিবার ধরা হয়, তাহলে মাথাপিছু আয় অনুসারে ওই পরিবারটির আয় হওয়ার কথা বছরে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৫৬ টাকা। পরিবারের উপাজর্নক্ষম ব্যক্তিটির আয় যদি উল্লিখিত অঙ্কের হয়, তাহলে সেই ব্যক্তিটির আয় দেশের প্রচলিত আয়করের সীমার ঊধ্বের্, তিনি তাই আয়করভুক্ত হবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের যদি হতো, তাহলে দেশে আয়কর দাতার সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যেত। বাস্তবে কিন্তু তা দেখা যায় না। মাথাপিছু আয়ের অসম বণ্টনের তারতম্যের জন্যই করদাতাদের সংখ্যাটা এত কম। বাংলাদেশে নিবন্ধিত যেসব করদাতা রয়েছেন তাদের আয় এবং অথর্প্রাপ্তির উৎস্যটা পযাের্লাচনা করলে দেখা যাবে তারা আসলে তাদের করদাতা হিসাবে অন্তভুর্ক্ত না করলেও হয়। দেশে সরকারি কমর্কতার্ ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা করদাতাদের বড় একটা অংশ। পঁাচ লাখের কাছাকাছি হবে এ ধরনের করদাতার সংখ্যা। এই করদাতারা সরকারের কাছ থেকে বেতন পেয়ে থাকেন আর এই বেতনেরই টাকা আবার সরকারি কোষাগারে কর হিসেবে জমা দেন। বিষয়টা অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা দেয়ার মতো। এই শ্রেণির কমর্চারীদের প্রাপ্ত বেতনের কত টাকা আয়কর হয় তা হিসাবে করে দেখা দরকার। আর আয়করের টাকাটা কতর্ন করে বেতন প্রদান করলেই বিষয়টা সহজ হয়ে যায়। সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত টাকা আবার কর হিসাবে দিতে গিয়ে এই কমীের্দর নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। যেহেতু এ কমর্চারীদের অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই আর আয়করটা তাদের বেতনের আয় থেকে দিতে হয়, তাই এদের বেতনের আয়করটা কেটে বেতন প্রদান করাটাই শ্রেয়। অন্যদিকে ঠিকাদারদের আয়কর দেয়ার বিষয়টি সরকারি কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত কমীের্দর মতোই। কোনো প্রকল্পের যে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়, সেই ব্যয় থেকেই নিদির্ষ্ট হারে ঠিকাদারদের আয়কর কেটে রাখা হয়। ঠিকাদারি কাজের সিডিউলে বণির্ত হয়ে থাকে বিভিন্ন উপকরণের মূল্য আর এই মূল্যের অন্তভুর্ক্ত হয় কর ও ভ্যাট। তাই দেখা যায় কমর্ সম্পাদনের পর ঠিকাদার বিল নিতে গেলে তার সম্পাদিত কাজের বণির্ত উপকরণের মূল্যের মোট বিল দেয়া হয় আর সেই বিল থেকেই ভ্যাট ও কর কেটে নিট বিল প্রদান করা হয়। সুতরাং যখন ঠিকাদারি কাজের ইস্টিমেট বা প্রাক্কলন ব্যয় নিধার্রণ করা হয় তখনই ট্যাক্স-ভ্যাট তার অন্তভুর্ক্ত করে প্রকল্পের মোট প্রাক্কলন ব্যয় নিধাির্রত হয়ে থাকে। ঠিকাদারি প্রকল্পের অথর্টার যোগানদাতা সরকারের কোষাগার আর ট্যাক্স-ভ্যাট যা কাটা হয় তাও সরকারি কোষাগারেই জমা হয়। তাই এই ট্যাক্স-ভ্যাট খেলাটা না খেলে প্রাক্কলন ব্যয় নিধার্রণ করার সময় ট্যাক্স-ভ্যাট বাদ দিয়ে প্রাক্কলন ব্যয় নিধার্রণ করলে এ ঝামেলাটাও দূর হয়। উল্লিখিত বিষয় দুইটির মতো আরও অনেক এ ধরনের কর নেয়ার খাত রয়েছে, যা শুধু সংখ্যায় করদাতা বাড়ায় আসলের ঘরে তা কাযর্কর কিছুই না। এই ধরনের করদাতা হিসাব করে বাদ দিলে প্রকৃত করদাতা সংখ্যাটা যা আসবে তা খুবই নগণ্য। সরকারের উচিত এ ধরনের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে প্রকৃত করদাতাদের একটা চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরা। একটি তথ্য থেকে জানা যায়, সরকারের মোট করের আয়ের ৬০ শতাংশ আসে করপোরেট কর থেকে আর বাকি মাত্র ৪০ শতাংশ হলো ব্যক্তি খাত। ব্যক্তি খাতে প্রদত্ত আয়করের হিসাবটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ব্যক্তি খাতে কর প্রদানকারী বড় একটি সংখ্যা সরকারের কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে সরকারকেই প্রদান করছে। এভাবে আয়কর আদায় করার পরও দেশের মোট জিডিপির মাত্র ১১-১৫ শতাংশ আসে আয়কর থেকে। অথর্মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে এক সেমিনারে বলেছেন, আগামী ২০২১ সালে জিডিপির ৩০ শতাংশ যোগানদাতা হবে আয়কর। বতর্মানে দেশের আয়কর নিধার্রণের যে ব্যবস্থাটা রয়েছে তার সংস্কার করাটা প্রয়োজন। প্রত্যক্ষ কর আর পরোক্ষ করের খাতগুলো আরও সুনিদির্ষ্ট করা দরকার। ভ্যাট নামে যে করটা আদায় হয় তা সম্পূণর্ পরোক্ষ কর। আদায়কৃত অথর্ কতটা সরকারের কোষাগারে জমা হয় তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বড় বড় কোম্পানির ভ্যাট ফঁাকি দেয়ার বিষয়টা আমরা মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে দেখতে পাই। ভ্যাট নামক ট্যাক্সটা ভোক্তাই বহন করে, তাই কোনো উৎপাদকের মোট পণ্যের উৎপাদনের ওপর মূল্য নিধার্রণ করে ভ্যাটটা সরকার ওই উৎপাদকের কাছ থেকে আদায় করে নিলে অনিয়ম করার সুযোগটা কমে যায়। প্রকৃতাথের্ করদাতার যে সংখ্যাটা বতর্মানে রাজস্ব বোডর্ প্রকাশ করছেÑ এমন সংখ্যার বাইরে যে কোনো ধরনের একজন পণ্য ক্রেতাও পরোক্ষ করের আওতায় পড়েন। কারণ সরকারের কোষাগার থেকে বেতন পেয়ে যারা কর দেন তাদের চেয়ে অধিকতর শ্রেয় তিনি, যিনি রিকশা চালিয়ে একটি টুথপেস্ট বা সাবান কিনে যে ভ্যাটটা প্রদান করেন। এদেশের প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে সরকারকে রাজস্ব দেয়, তাই প্রত্যক্ষভাবে নিজের শ্রম বা পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে যারা কর দিচ্ছে তাদের প্রকৃত সংখ্যাটা জানা দরকার। কারণ ঠিকাদারি বিল আর সরকারি বেতনপ্রাপ্তরা প্রকৃত করদাতার হিসাবে ধরাটা যথাথর্ হয় না। কারণ এরা সরকার আশ্রিত হয়েই আয় করছে আর সেই আয় থেকে টাকা নিয়েই কর দিচ্ছে। প্রকৃত করদাতা তারাই যারা সরকারের সহযোগিতা ছাড়া আয় করে সরকারের কোষাগারে কর দেয়। তাই এ ধরনের দুটি বিষয়কে পৃথক করে করদাতার সংখ্যা প্রকাশ করা দরকার। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক