পাঠক মত

আকাশ সংস্কৃতির গ্রাসে দেশীয় সংস্কৃতি

প্রকাশ | ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মো. তাসনিম হাসান আবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পৃথিবীর বুকে আমাদের এই উপমহাদেশ সংস্কৃতিমনা মানুষের আবাসস্থল বলে পরিচিত। আমাদের এই উপমহাদেশে আছে হাজার হাজার বছরের পুরনো, ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি। যা আমরা বংশানুক্রমে ধারণ করে আসছি। সেই হিসেবে আমাদের মাতৃভ‚মি বাংলাদেশেও আছে হাজার বছরের ঐতিহ্যগত বাঙালি সংস্কৃতি। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এখন পযর্ন্ত আমরা বাঙালির এই চেতনা, আদশর্ ও সংস্কৃতির ধারা বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সেটা রক্ষা করতে ব্যথর্ হচ্ছি। আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে অনেক অপসংস্কৃতি আমাদের এই পুণ্যভ‚মিকে কলুষিত করছে। বিদেশি বিভিন্ন চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশীয় চ্যানেলগুলোর মাঝে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে আজকে আমাদের এই সংস্কৃতি হুমকির মুখে। বতর্মান আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের অন্য দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কিন্তু তাই বলে নিজের সংস্কৃতি ভুলে অন্যেরটা ধারণ করা যাবে না। আজকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বাঙালির লোকগাথা, লোকসংস্কৃতি, লালনগীতি এগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত না। তারা দেশের বিখ্যাত লালনগীতি বা লালন শিল্পীর নামবলতে পারে না। কিন্তু বিদেশি গান বা বিদেশি শিল্পীর নামসহ পুরা বৃত্তান্ত তারা বলতে পারবে। আজকে শত বছরের পুরনো লোকসংগীতের মেলায় বা আসরে কয়জন লোক হয় আর একটা বিদেশি শিল্পীর কনসাটের্ কত জন লোক হয়! এটা দেখলেই বতর্মান অবস্থা বোঝা যায়। আজকে দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘র‌্যাগ ডে’-তে বিদেশি গানের হুল্লোড় পড়ে যায়। দেশসেরা, জাতির ভবিষ্যৎ কাÐারীরা আজকে বিদেশি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আনন্দ করে, নিজের দেশের সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে। আজকে আমাদের পরিবারে নিজেদের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। বিদেশি সিরিয়ালগুলো আজকে আমাদের বেশিরভাগ বাঙালিদের ঘরে জনপ্রিয়তায় শীষের্। সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হিংসা, বিদ্বেষ, পরকীয়া এগুলো আজকে আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখা যায় যে সিরিয়াল দেখতে বাধা দেয়ার কারণে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন বা সিরিয়ালের নায়িকার নামে করা পোশাক না কিনে দেয়াতে প্রাইমারি পড়ুয়া শিক্ষাথীর্র আত্মহত্যা। এই অবক্ষয়গুলো আমাদের সংস্কৃতিতে আগে ছিল না। এগুলো এই বিদেশি সিরিয়ালের প্রভাবে প্রভাবিত ঘটনা। এখন অনেক উৎসবের সময় দেখা যায় যে বাঙালির ঐতিহ্য জামদানি শাড়ি বা দেশীয় পোশাকের তুলনায় বিদেশি সিরিয়ালের নামধারী নায়িকাদের পোশাকের চাহিদা বেশি। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের শত বছরের সংস্কৃতির ধারা। এখন আবার আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোর মাঝে ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়াল প্রদশের্নর অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। কয় একদিন আগে পযর্ন্ত তুরস্কের সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’ ছিল আমাদের দেশে সব থেকে জনপ্রিয় সিরিয়াল। সব বয়সের মানুষের কাছে এটার ছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তারই ধারাবাহিকতায় এখন অন্যান্য আরও চ্যানেল খুব ঘটা করে এগুলোর আমদানি করছে ও প্রদশর্নী করছে। আবার এগুলোর প্রচারের জন্য ঘোড়ার গাড়িতে করে তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূণর্ পয়েন্টে যাচ্ছে। এগুলো আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির জন্য অনেক বড় হুমকি। লাখ লাখ শহীদের রক্তে ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই বাঙালি জাতিসত্তা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার জন্য আমরা অন্যান্য সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবো কিন্তু ধারণ করব নিজের সংস্কৃতি এবং বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দেব আমাদের এই মহান জাতির সংস্কৃতি। কারণ আমাদের এই বাঙালি সংস্কৃতির ভাÐার পরিপূণর্। আমরা যদি এগুলোর নিয়মিত সুষ্ঠু চচার্ করি তাহলে আমাদের সমাজের এই অবক্ষয় অচিরেই দূরীভ‚ত হবে। একটা জাতি তখনই উন্নতির চ‚ড়ায় আরোহণ করে যখন তারা তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর একটা জাতির অবক্ষয় তখনই হয় যখন তারা তাদের নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে অন্যের সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি করে। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন দেশপ্রেম। কারণ আজকাল মানুষ তাদের দৃষ্টিতে যেটা ভালো সেটাই গ্রহণ করে। তাই আমাদের এই মহান মাতৃভ‚মির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদশর্ন করে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা করব ও এর ধারা অক্ষুণœ রাখব। আমরা এই বাংলাদেশের মহান বাঙালি জাতি, আমাদের রয়েছে নিজস্ব জাতিসত্তা, পরিপূণর্ বাঙালি সংস্কৃতি। তাই আমরা নিজেরা এই ঐতিহ্য বুকে ধারণ করব এবং বিশ্বের মাঝে আমাদের এই সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেব।