অবাধে বৃক্ষ নিধনে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

সাঈমা আক্তার শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ পরিবেশের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে যেমন নির্মল রাখে তেমনি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে প্রাণীর বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নির্গমন করে। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে দিনে দিনে প্রতিনিয়ত গাছ নিধন হচ্ছে। এর কারণে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে; আবহাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাছ নিধনের কারণে বৃষ্টিও হচ্ছে না। বৃষ্টির অভাবে আমাদের নিত্যজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গাছ নিধনের ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে; বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়ছে। গাছ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও অণুজীবের আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বিচারে বন নিধনের কারণে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ ও পশুপাখি বিলুপ্তির পথে। অতি সাধারণ প্রাণী, যেমন- শিয়াল, বেজি, খরগোশ, কাঠবিড়ালি, বানর, হনুমান, চিল, শকুন, ডাহুক, বাবুই, চড়ুইসহ আরও অনেক পশুপাখি আগের মতো দেখা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ দেশের বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে যাওয়া। নির্বিচারে বন উজাড় ও জনসংখ্যার চাপে দিনে দিনে তা আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি বছরই কারণে-অকারণে প্রচুর গাছ কাটা হয়, রোপণ করা হয়, তাও আবার পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে বনাঞ্চল বা বনভূমি দিনে দিনে উজাড় হচ্ছে। ফলে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে। কালবৈশাখী ঝড়, সাইক্লোন, অকাল বন্যা প্রভৃতি দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে কোনো দেশের ২৫% ভূমিতে বনজঙ্গল থাকা দরকার। সেই তুলনায় বাংলাদেশে গাছ নিধনের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে বনভূমি নেই। গত বছরে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এই তথ্য মানতে নারাজ। মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি আছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষরাজি শব্দদূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে বনের জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই সরকার বর্তমানে বনভূমি রক্ষা করার পাশাপাশি বনের বাইরে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক প্রাণী গাছ খেয়ে বেঁচে থাকে আবার গাছই তাদের একমাত্র আবাসস্থল। বন উজাড়ের কারণে এসব প্রাণী যেমন তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারছে না তেমনি আবাসহীন হয়ে পড়ছে। ফলে এ সব প্রাণী দিনকে দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বন উজাড়ের দরুন নানা জাতের গাছগাছালি, নানা জাতের প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষার্থে গাছ নিধন বন্ধ করতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ এবং কঠোর আইন প্রণয়ন ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। মানুষের অত্যাচারে প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারণ করেছে! অবাধে বৃক্ষ নিধন আর পাহাড় কাটার ফলেই প্রকৃতি ক্ষেপে উঠেছে! প্রকৃতির এই রুদ্র আচরণ থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। খাদ্য, জ্বালানি, আসবাবপত্র তৈরি, গৃহনির্মাণ, ওষুধ, সৌন্দর্যায়ন প্রকৃতির জন্য আমরা গাছ লাগাই। সবচেয়ে বড়কথা গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করি। আর অক্সিজেনের মাধ্যমে আমরা বেঁচে থাকি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ইদানীং একটি বিশেষ মহল কর্তৃক সারাদেশেই ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন চলছে। বন বিভাগের ফাইলপত্র ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, দেশের যে সব এলাকায় কিছু বনাঞ্চল ছিল তা নির্বিচারে কেটে শুধু উজাড়ই করা হচ্ছে না নিশ্চিহ্নও করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন, কুমিলস্না ও সিলেট অঞ্চলের মূল্যবান বৃক্ষাদি কেটে বনভূমি উজাড়ের খবর দেশের সব মহলের জানা। এ কাজে বন বিভাগের ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তার সঙ্গে রয়েছে অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় বনাঞ্চলের বিকল্প নেই। একথা ইতোমধ্যে বিশ্বের সব মানুষ অনুধাবন করতে শুরু করেছে। তাই লাখ লাখ ডলার খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যের বালুর পাহাড়ে বৃক্ষচারা রোপণ, পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করা হচ্ছে। মরুময় এসব দেশে গাছপালার বদৌলতে বৃষ্টিপাত হতে শুরু হয়েছে। নিত্যদিনের ব্যবহার্য শাক-সবজি আজ তারা নিজেরাই উৎপন্ন করছে। কোনো কোনো দেশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় রপ্তানিও করছে। সরকার বনভূমি থেকে প্রতি বছর বেশ মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় করে থাকেন। এ আয় থেকে অন্তত চার ভাগের এক ভাগও যদি আন্তরিকতা, সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বনাঞ্চল সৃষ্টিতে ব্যয় করতেন তাহলে সবুজ, সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশটির এ জীর্ণশীর্ণ অবস্থা হতো না। আবার কোথাও প্রচুর বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাচ্ছে ক্ষেত, খামার, বাড়িঘর, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি। দেশে জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন বেশ ভালো করে অনুভব করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ দেশের বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে যাওয়া। নির্বিচারে বন উজাড় ও জনসংখ্যার চাপে দিনে দিনে তা আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি বছরই কারণে-অকারণে প্রচুর গাছ কাটা হয়, রোপণ করা হয়, তাও আবার পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে বনাঞ্চল বা বনভূমি দিনে দিনে উজাড় হচ্ছে। ফলে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে। কালবৈশাখী ঝড়, সাইক্লোন, অকাল বন্যার তান্ডব দেখা দিচ্ছে। এ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রাখা। এদিকে নজর না দিলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে ওঠার আগে আমাদের সচেতনতার সঙ্গে যেখানে সম্ভব বৃক্ষরোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় আমাদের মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। ইদানীং ইটের ভাটায় অবাধে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। আইন ও নিয়মনীতি না মেনে গড়ে ওঠা পরিবেশ বিধ্বংসী এ সব ইটের ভাটা এখন জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ইটভাটার অনুমোদন প্রদান করেন জেলা প্রশাসক। ইটের ভাটায় ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮৯-এর আওতায় জেলা প্রশাসক ইটভাটার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এককভাবে ক্ষমতাবান। উদ্যোক্তা ইটভাটা নির্মাণের সূচনা করলে তা প্রথমেই নজরে আসে জেলা প্রশাসকের। ইটভাটার লাইসেন্সের আবেদনের সূত্রপাত ঘটে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে। আবার ইটভাটা নির্মাণে জমি দখল ও পরিবেশ দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কান্না, আর্তি ও অভিযোগ সবার আগে পৌঁছে জেলা প্রশাসকের কাছেই। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক। ভূমি নিয়েই ইটভাটার পুরো কর্মযজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনা। ইটভাটার জন্য উদ্যোক্তারা জমি ভাড়া, দখল, মাটি কর্তন ও মাটি পুড়িয়েই ইট তৈরি করেন। ইটভাটা এক রাতেই গড়ে ওঠে না। এ বিশাল কার্যক্রম শুরু ও শেষ করতে প্রয়োজন দুই থেকে তিন মাস। এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও ইটভাটা নির্মাণের অনেক ঘটনা জেলা প্রশাসকদের অগোচরে থেকে যায়। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলি জমি ভরাট করে, জমিতে গর্ত করে, গ্রামীণ নৈঃশব্দ ভেঙে ইটবাহী ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরি করে, গাছপালা উজাড় করে এবং পাহাড় কেটে প্রচুর ইটভাটা গড়ে উঠছে। অর্থের প্রয়োজনে ইটভাটা এবং ইটভাটার প্রয়োজনে কৃষি জমি- এ দুইয়ের যোগসূত্র এখন অবিচ্ছিন্ন। ইটভাটার লেলিহান শিখায় মুনাফালোভী ইটভাটার মালিকরা জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামবাংলার সবুজ ধানক্ষেত ও চোখ জুড়ানো পরিবেশ। কেড়ে নিচ্ছে মানুষের অনাবিল শান্তি, হরণ করছে স্বস্তি। অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছ সবুজ বন-বনানী। ধ্বংস হচ্ছে অর্থনীতি। ভরাট হচ্ছে নদ-নদী। গত আড়াই বছরে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে এ সব ঘটনা বেরিয়ে এসেছে প্রতিনিয়ত। এ কারণে গ্রামীণ জনপদের উর্বর মাটি পরিণত হয়েছে সোনার খনিতে। সে খনি থেকে বেরিয়ে আসছে কাড়ি কাড়ি টাকা। শুধু একটি মৌসুমেই ইটভাটা মালিকের লাভ থাকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। ইটভাটা তৈরিতে ভারী অবকাঠামো বা উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। শ্রমশক্তি সহজলভ্য, জমিও অতি সস্তা। অভাবতাড়িত কৃষক, দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমিক পেটের দায়েই চোখ বুজে শ্রম দিচ্ছে ইটভাটায়। অনেক কম ব্যয় অথচ অনেক বেশি মুনাফা এতে। অপরিণামদর্শী কিছু উদ্যোক্তার পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপে ইটভাটার নামে এভাবেই কৃষির সর্বনাশ এবং জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির কবলে পড়ছে। কিন্তু এ সব নিষ্ঠুর বাস্তবতা বিবেচনায় না এনেই দিন দিন এ ধ্বংসাত্মক বিনিয়োগের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে উদ্যোক্তাদের। এ উদ্যোগ স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে প্রবাসী এমনকি অনেক সম্মানজনক পেশার মানুষ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ও পরিবেশগত প্রভাবকে অবহেলায় রেখে ইটভাটা ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গ্রামে-গঞ্জে ও বনে-বাদাড়ে ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা এ সব ইটভাটার সিংহভাগেরই নেই বিএসটিআই লাইসেন্স বা পরিবেশ ছাড়পত্র। এ সব ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের গুণগত মান নিশ্চিত করারও কেউ নেই। বন উজাড়করণ বলতে ব্যাপক হারে বৃক্ষ কর্তনকে বোঝায়। বর্তমানে এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন উজাড়করণের অনেক কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বন উজাড় করার প্রধান কারণ। মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কাঠ ব্যবহার করে। বৃক্ষ কেটে বনভূমিতে তারা তাদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। ফলে, দ্রম্নত গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। মানুষ এবং প্রাণীর ওপর বন উজাড়করণের অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। বন উজাড়করণ বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করে। একটি পরিবেশগত ভারসাম্য বাধাগ্রস্ত করে। এটি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে আনে। বন উজাড়করণ প্রাণিকূলেরও ভীষণ ক্ষতি করে। বন উজাড় করার কারণে বেশির ভাগ প্রাণী তাদের বসবাসের স্থান হারিয়েছে। জলবায়ুর ওপর এটির অনেক ক্ষতির প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে আমাদের জলবায়ুর আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সমুদ্র উচ্চতা ভীতিকর মাত্রায় বাড়ছে। বন উজাড় বন্ধে কর কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বৃক্ষ নিধনের ক্ষতিগ্রস্ত পরিণতিগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে।