মনীষা অন্বেষণ: আলোর দিশারি

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অজির্ত একটি দেশের সংবিধানে স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের চৈতন্যই কাজ করবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল চারটি মৌলনীতি। সেগুলোই সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গণ্য হয়। মূলনীতির অন্যতম হলো ধমির্নরপেক্ষতা। ধমির্নরপেক্ষতা কখনোই কোনো ধমের্র সঙ্গে সাংঘষির্ক নয়। ধমের্র সম্মান সমুন্নত রাখতেই এর প্রয়োজন। ড. আনিসুজ্জামান ধমর্রাষ্ট্র, ধমির্নরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধমের্র ভেতরকার সম্পকর্ ও বৈপরীত্যের স্বরূপ পযের্বক্ষণ করেছেন।

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আতা সরকার
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে কেন্দ্র করে বিশেষ পাঠচক্রের শুরু করেছে বাংলার পাঠশালা। কমর্শালায় অনুসন্ধান চলবে এক প্রজ্ঞাপন মনীষীর মনন ও মেধার যিনি দেশ, জাতি, সমাজ জনমানুষের জন্য নিরলস অবদান রাখছেন। জ্ঞানবান বৃক্ষকে আন্দোলিত করলে যেমন তার যথাসম্ভব চ‚ড়ান্ত রসাস্বাদন নিশ্চিত করা সম্ভব, তেমনি মনীষার গভীরে অন্বেষার মাধ্যমে প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করার রসদ ব্যাপকভাবে আহরণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি : অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শীষর্ক পাঠচক্রে ৮টি বিষয়ের ওপর ১০টি ক্লাসের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। পাঠচক্রের বিষয়বস্তু হলোÑ ড. আনিসুজ্জামানের জীবন ও কমর্, সংস্কৃতি শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্য চিন্তা, তার গবেষণা, ভাষা আন্দোলন, যুবলীগে তার ভ‚মিকা, রবীন্দ্র বজর্ন বিরোধিতা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সাম্প্রদায়িক বিরোধিতা, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ধমির্নরপেক্ষতার বিশ্লেষণ, বাঙালির আত্মপরিচয়, বাংলা নানান অভিধান, ফরাসি বাংলা অভিধান, বাংলাদেশ সংবিধানের পরিভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্র, সংবিধান এবং যুদ্ধাপরাধ বিচার। এসবের প্রেক্ষাপটে ড. আনিসুজ্জামানকে নতুনভাবে আবিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে। যুথবদ্ধ এ পাঠচক্রে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সম্মিলিত সংযোগ ঘটাচ্ছেন সমকালীন অন্য মনীষী ও পÐিতরা। প্রবীণ বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামানের উপর ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ স্মারকগ্রন্থ ও অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। তার ভক্ত ও গুণগ্রাহীরা এ গ্রন্থে তার প্রতি শতর্হীন ভক্তি প্রকাশ যেমন করা হয়েছে তেমনি, তার কমর্বহুল চলমান জীবনের সচিত্র ধারাক্রমও গ্রন্থিত হয়েছে। এ গ্রন্থগুলোয় তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কোনো ঘাটতি নেই। ড. আনিসুজ্জামান সমকালীন সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেক। আধুনিকমনষ্ক, শিল্পসাহিত্য, সাংস্কৃতিক তৎপরতায় অগ্রগণ্য ভ‚মিকাতেই তিনি শুধু বিশিষ্ট নন, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহে তার সুস্পষ্ট উচ্চারণ তাকে সুশীল নাগরিক সমাজে পথিকৃতের আসন দিয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্বৎসমাজে অবিতকির্ত সম্মানজনক স্থানটি তার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষার প্রায় সব প্রগতিচচার্য় তার সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। একইভাবে ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন বিরুদ্ধসংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতা রোখার লড়াই, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ঘাতক-দালাল বিচারে সাক্ষ্য প্রদান, গণজাগরণ মঞ্চ, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তিনি এগিয়ে এসেছেন নিঃসংকোচে নিদ্ধির্ধায়। সমাজের বিশিষ্ট ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, সাংস্কৃতিককমীর্ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদরা তার এ কাযর্ক্রমগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পযের্বক্ষণ করেছেন। পযাের্লাচনাও করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিকচচার্য় তার অনুপস্থিতি যে গভীর শূন্যতা তৈরি করবে এ ব্যাপারে আজ আর কারও কোনো দ্বিধা নেই। এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে তার সত্তা মিশে আছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার সত্যপরতা আমাদের চোখে পড়ে। আমরা তাকে নিষ্ঠা আন্তরিকতা উদ্যমকে শ্রদ্ধা জানাই। তার এই তৎপর কাযর্ক্রমের মধ্য দিয়েই আমরা তাকে জানতে চাই, বুঝতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই। তার প্রাজ্ঞ তারুণ্যবোধকে আমরা ধারণ করতে চাই। ড. আনিসুজ্জামানের এ কমর্জগৎ সুবিস্তৃত। কিন্তু এ জগৎই তার একমাত্র জগৎ নয়। তার কাজের ও অস্তিত্বের মূল ভ‚খÐটি আরও প্রসারিত ও গভীর। এর মাধ্যমেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের বিদ্বৎসমাজে স্বীকৃত ও নমস্য। তার গবেষণা এবং মননশীল সৃজনসমৃদ্ধ চিন্তাধারা আমাদের জাতিসত্তা, অস্তিত্ব ও জীবনবোধের উৎসমূলে পেঁৗছে দিতে চায়। তার এ জগৎ সম্পকের্ আমাদের অবগতি রয়েছে। কিন্তু তার অনুসন্ধানের বিশ্লেষণ ও আলোকসম্পাত ঘটেছে কমই। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পুনগর্ঠনের শুরুতে যে কয়েক প্রতিভা ভাগরিত হয়ে উঠছিল, ড. আনিসুজ্জামান তার তরুণ বয়সেই সামনে এগিয়ে ছিলেন। গবেষণা, অনুসন্ধিৎসা ও মুক্তভাবে পযের্বক্ষণ ও বিশ্লেষণে মুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগে পরিশ্রমী গবেষক হিসেবে সূচনাকালেই তিনি দৃষ্টি আকষর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাকিস্তান বলয়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের উত্থান সম্পকের্ পযের্বক্ষণ করতে গিয়ে নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছিলেন : ‘সীমানার ওপারে পূবর্ বাংলায় তরুণ লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শ্রম ও নিষ্ঠার, বুদ্ধি ও বোধের কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গিও কী অথর্গভর্ বিবতর্ন, কী বৈপ্লবিক উদ্দীপনা দেখা দিচ্ছে। এসব গবেষণা, গ্রন্থের মাধ্যমে তার কিছু কিছু আভাস পেতাম। স্পষ্টতর আভাস পাওয়া যেত তাদের কণ্ঠের গানে। রচিত গল্প ও কবিতায়, প্রমাণ পাওয়া যেত তাদের নানা অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানান্বেষণের বিচিত্র উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্যে। ...পূবর্ বাংলায় আমার জন্মভ‚মিতে সমাজজীবনে এক নবজন্মের সূচনা হচ্ছে।’ এ প্রেক্ষাপটে নীহাররঞ্জন রায় ড. আনিসুজ্জামান সম্পকের্ মন্তব্য করেন, ‘আমি তরুণ গবেষকের শ্রম, নিষ্ঠা ও অনুসন্ধিৎসায়, তার তথ্য সংগ্রহের শৃঙ্খলায়, তার তথ্যনিভর্র যুক্তিতে, সবোর্পরি তার স্বচ্ছ মুক্তবুদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির ঔদাযের্ সাতিশয় প্রীত ও বিস্মিত হয়েছিলাম। আজ থেকে প্রায় অধর্ শতাব্দীর আগের এ মন্তব্য আজও আনিসুজ্জামানের জন্য প্রযোজ্য গবেষণার বলয়ে তার সযতœ তথ্য সংগ্রহ, যুক্তিসিদ্ধ বিশ্লেষণ, পযের্বক্ষণ উদারনৈতিকতা এবং সবোর্পরি অনুসিদ্ধান্তে মুক্তবুদ্ধির প্রয়োগ তার প্রতিভা ও মনীষার তারুণ্যদীপ্তিই প্রকাশ করে। একজন গবেষকের যে নিমোর্হতা, যে কোনো অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণের পর যুক্তিতকর্ তথ্য-প্রমাণ ভিন্নমাত্রা সংযোজন করলে অনুসিদ্ধান্তের সংস্কার করার মানসিকতাÑ তার জাগ্রত বোধিসত্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। ড. আনিসুজ্জামানের অভিসন্দভর্ ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুক্তমনের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ নামে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত এ গবেষণাগ্রন্থ সে সময়ই আলোড়িত হয় এবং ব্যাপক আলোচিত হয়। পরবতীর্ গ্রন্থাগুলোও তার গবেষণায় মৌলিকত্বের ছাপ সুস্পষ্ট করে এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার মতো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূণর্ আবিষ্কার সংযোজন করতে সক্ষম হন। মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, পুরনো বাংলা গদ্য, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, বাঙালি নারী: সাহিত্যে ও সমাজে, পূবর্গামী, বাঙালি ও বাংলাদেশ, নিবাির্চত প্রবন্ধ, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধÑ বাংলায় রচিত এ গ্রন্থগুলো ছাড়াও ইংরেজিতেও তার বেশ কয়েকটি গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে। তিনি মুনীর চৌধুরী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে নিয়েও পৃথক পৃথক কাজ করেছেন। সম্পাদনা করেছেন প্রচুর গ্রন্থ যেগুলোতে সম্পাদক হিসেবে তার গবেষণা, পযের্বক্ষণ, পযের্বক্ষণ ও ভাষ্য তার মনীষার বিচ্ছুরণ প্রকাশ করে। অভিধান ও পরিভাষার কাজ করেছেন। বাংলা একাডেমির ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে’র তিনি প্রধান সম্পাদক। এর দুটি খÐ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, আরও তিনটি খÐ অপেক্ষমান। সামাজিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিই বৃত্তের বাইরে তার যে আরেকটি বিশাল জগৎ রয়েছে যার জন্য তিনি উপমহাদেশের জ্ঞান জগতে সমাদৃত, তার সামান্যতম পরিচয়ই উপরে তুলে ধরা হলো। ড. আনিসুজ্জামান সাহিত্য ও ভাষা নিয়ে গবেষণা করলেও সত্য আবিষ্কারের জন্য তাকে নিয়োজিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট সমাজ বিশ্লেষণে এবং অথর্নীতিচচার্য়। পযের্বক্ষণ করতে হয়েছে রাজনৈতিক চরিত্র। এ ক্ষেত্রে এক চক্ষুষ্মান হলে ভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে বিলক্ষণ। তাই তাকে রাখতে হয়েছে খোলা চোখ, প্রয়োগ করতে হয়েছে মুক্তবুদ্ধি। ইংরেজ আমলে বাঙালি মুসলমানের মানস ও সাহিত্য খুঁজতে গিয়ে তিনি পযের্বক্ষণ করেন : ‘মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অবদানে সমৃদ্ধ। এর তুলনায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎপদতা বিস্ময়কর।... আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রস্তুতিপবের্ বাঙালি মুসলমান সম্পূণর্রূপে নিষ্ক্রিয়। অথচ তাদের সাহিত্যানুরাগ বা সৃষ্টিক্ষমতা যে লোপ পায়নি, তার প্রমাণ আরবি-ফারসি শব্দবহুল কাব্যধারার মধ্যে পাওয়া যায়।... বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-সাধনার ইতিহাসে এই কাব্যধারা মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মধ্যে ঐতিহাসিক সূত্র রক্ষা করেছে মাত্র।’ সে সময়কার মানস অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি আথর্-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিও দৃষ্টিপাত করেছেন : ‘ইংরেজ-শাসনকালে আমাদের সমাজব্যবস্থায় কতকগুলো মৌলিক পরিবতর্ন দেখা দেয়। গ্রামকেন্দ্রিক স্বয়ংসম্পূণর্ সমাজে ভাঙন ধরে। জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে শহরমুখী। আর অথৈর্নতিক জীবনের মূল মাপকাঠি জমি থেকে রূপান্তরিত হয় মুদ্রায়। অথৈর্নতিক কাঠামোর এই মৌলিক রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নতুন শ্রেণিবিন্যাস দেখা যায়। নবগঠিত এসব শ্রেণি আবার ঐতিহাসিক নিয়মানুযায়ী নিজেদের ভ‚মিকা পালন করে সামাজিক অগ্রগতি সম্ভবপর করে তোলে।’ সমাজ ও অথর্নীতি বিকাশ ও নবতর বিন্যাস এবং তার প্রভাব তিনি এখনো পযের্বক্ষণ করছেন। সাম্প্রতিক রচনাগুলো থেকেও তার এই মুক্তবিশ্লেষণের পরিচয় পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ‘বাঙালির আত্মপরিচয়’ সন্ধানে তার মুক্তমন কতকগুলো বাস্তব ও সত্য মানসিকতার মুখোমুখি হয়। বাঙালি ও বাংলাদেশি পরিচয় বিবদমান হয়ে রাজনৈতিক কারণে মুখোমুখি দঁাড়ায়। ড. আনিসুজ্জামান পূবার্পর বিশ্লেষণ করে সুস্পষ্ট ভাষায় মতপ্রকাশ করেন : ‘নাগরিকত্বের পরিচয় এবং নৃতাত্তি¡ক পরিচিতিকে স্বতন্ত্র ধারায় দেখলে বাঙালি ও বাংলাদেশির মধ্যে বিরোধের সুযোগ থাকে না।’ তিনি আত্মপরিচয়ের সংকট দেখতে পান ভিন্ন ক্ষেত্রে। বতর্মান সামাজিক প্রেক্ষাপটে। তার পযের্বক্ষণ : ‘বাংলাদেশে অবশ্য বাঙালি আত্মপরিচয় সমুন্নত রাখার চেষ্টাটাই যথেষ্ট পরিমাণে দুবর্ল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় কাজে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাভাষার ক্রমহ্রাসমান ব্যবহারে তার পরিচয় পাওয়া যাবে বিশেষ করে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর নাগরিক মধ্যবিত্তের অপ্রত্যাশিত বিত্ত সঞ্চিত হয়েছে। তারা এখন সন্তানদের বিদেশে পড়াতে এবং সম্ভবপর হলে সেখানে অভিবাস করাতে চায়। ফলে পোষ্যদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে ইংরেজি ভাষাকে এসব ছেলেমেয়ের দ্বিতীয় নয়Ñ প্রথম ভাষা করে তুলতে তারা আগ্রহী।’ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি এখনো উদ্দীপনাসহকারে শ্রদ্ধা জানানো হয়, বাংলা নববষর্ ক্রমবধর্মান উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়, কিন্তু বাংলা ভাষার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগ ক্রমে বিলীয়মান হয়ে পড়ছে।’ তিনি সংকটটিকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছেন : ‘আজ বাঙালি আত্মপরিচয় নানারকম হুমকির মুখে বিশ্বায়ন, কোনো না কোনো ধরনের মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতা, হিন্দি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের প্রভাব।’ কিন্তু আশাবাদী ড. আনিসুজ্জামান প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, বাঙালি আত্মপরিচয়ের অপরাজেয় ভাব সব প্রতিক‚ল বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যাবে।’ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে বিশেষ করে এর বাংলা ভাষা রচনায় তিনি সহযোগের ভ‚মিকা পালন করেছিলেন সংবিধান প্রণেতাদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অজির্ত একটি দেশের সংবিধানে স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের চৈতন্যই কাজ করবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল চারটি মৌলনীতি। সেগুলোই সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গণ্য হয়। মূলনীতির অন্যতম হলো ধমির্নরপেক্ষতা। ধমির্নরপেক্ষতা কখনোই কোনো ধমের্র সঙ্গে সাংঘষির্ক নয়। ধমের্র সম্মান সমুন্নত রাখতেই এর প্রয়োজন। ড. আনিসুজ্জামান ধমর্রাষ্ট্র, ধমির্নরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধমের্র ভেতরকার সম্পকর্ ও বৈপরীত্যের স্বরূপ পযের্বক্ষণ করেছেন। ড. আনিসুজ্জামানকে বিশ্লেষণ ও আবিষ্কার করতে হলে তার সমগ্র সৃজন-ভুবনে পদচারণা করতে হবে। তাহলেই উপলব্ধি করা যাবে তার ব্যাপকতা ও মৌলিকত্ব। তার আলো দিয়েই আমাদের ভেতরে আলো জ্বালাতে হবে। আতা সরকার: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক