বিপ্লব ও সংহতি দিবসের তাৎপযর্

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারী খালেদ মোশাররফ এই চেতনার মোকাবেলায় সম্পূণর্রূপে ব্যথর্ হন। প্রথম আঘাতেই, বিশেষ করে যখন সিপাহি-জনতার মুখে ভারতবিরোধী ¯েøাগানগুলো উচ্চারিত হতে থাকে, সেই অভ্যুত্থান ঘায়েল হয়ে পড়ে। আজ জিয়াউর রহমান, তাহের এবং খালেদ মোশাররফ ইতিহাস। প্রশংসা বা সমালোচনার ঊধ্বের্ তারা। তাই এই দিনে তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন প্রয়োজন, কেননা যে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় বলে চিহ্নিত করি সেই মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিপুরুষ তারাই।

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

এমাজউদ্দীন আহমদ
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতি দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দুই কৃতী সৈনিকের নাম, এ দেশের দুই মহান সন্তানের চিন্তা-ভাবনা। একজন আবু তাহের এবং অন্যজন জিয়াউর রহমান। দুজনই অত্যন্ত উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আপন আপন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই। তাদের পাশাপাশি রয়েছে খালেদ মোশাররফের নাম। তিনিও একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধার কৃতিত্ব ও ব্যথর্তার পটভ‚মিকায় সৃষ্টি হয়েছে ৩ নভেম্বরের অধ্যায়। এ অধ্যায় বাংলাদেশ রাজনীতির গতিপথে এক সুস্পষ্ট মাইলফলক। সুনিদির্ষ্ট পথনিদেের্শর এক সূচক। কথাগুলো বলছি এই জন্য যে, ৭ নভেম্বরের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে সূচিত হয় বহুমুখী ধারা। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের যে আশীবার্দ মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ তার জয়যাত্রা শুরু করেছিল এবং মাঝপথে যার গতি রুদ্ধ হয়েছিল সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনবার্সনের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। খÐ-বিচ্ছিন্ন-অনৈক্যে ভরা জাতীয়জীবনে নতুনভাবে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির সূচনা হয় ওই সময় থেকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহাযর্ শতার্বলি, যেমন বহু দল, স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন সংবাদপত্র প্রভৃতির ক্রমবিকাশের পথও হয় সুগম। অথৈর্নতিক ক্ষেত্রেও আধুনিক অথর্নীতির বৈশিষ্ট্যগুলো একে একে বিকশিত হতে থাকে। আন্তজাির্তক ক্ষেত্রে রুশ-ভারতের কক্ষপথের অন্ধকার থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মুক্তি লাভ করে বিশ্বময় বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ পায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ হলো মুক্তিযুদ্ধের অনলকুÐ থেকে প্রাণ পেয়ে বাংলাদেশ যেভাবে মাথা উঁচু করতে শিখেছিল, নতুনভাবে আবারও মাথা না নোয়ানোর সঙ্কল্প লাভ করে ৭ নভেম্বরের পর। এ আন্দোলনে সৈনিক এবং জনতার মধ্যে এতদিন পযর্ন্ত যে অনতিক্রম্য ব্যবধান বিদ্যমান ছিল তাও অপসারিত হয়। জাতীয় স্বাথর্ সংরক্ষণের গুরুত্বপূণর্ পদক্ষেপে সিপাহি ও জনতার সম্মিলিত উচ্চকণ্ঠ সমগ্র সমাজকে সচকিত করে তোলে। এ বিপ্লবের নাম-ভ‚মিকায় ছিলেন কনের্ল আবু তাহের। প্রথমে সামরিক বাহিনীকে ‘শ্রেণিহীন’ করে গড়ে তোলে, তাকে তীব্রভাবে ‘সচেতন’ এবং ‘শানিত’ করে তারই মাধ্যমে বাংলাদেশে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের পরিকল্পনা ছিল তার। এই লক্ষ্যেই ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোয় বহুসংখ্যক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠিত হয়েছিল। তার এই পরিকল্পনার অংশীদার ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। কনের্ল তাহের ছিলেন জাসদের গণবাহিনীর প্রধান কমর্কতার্। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একবার হাতে এলে শ্রেণিহীন সমাজ গঠন সহজতর হয়ে উঠবেÑ এই বিশ্বাস নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান এই বিপ্লবের সূচনায় ছিলেন না। ছিলেন না এর সমাপ্তি পবের্ও। কিন্তু এই বিপ্লবের উত্তাল তরঙ্গে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্চ বেদিতে চলে এলেন, যদিও এই নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি গৃহবন্দি হন। এই উদ্যোগ ব্যথর্ হলো কেন? এর উত্তর খুব সহজ নয়। আমি মনে করি, কনের্ল তাহের এবং জাসদের নেতারা তখনকার সামাজিক চেতনায় যে দুটি ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল সে সম্পকের্ পুরোপুরি সচেতন ছিলেন না। সমাজতান্ত্রিক পুনগর্ঠনের চেতনায় তারা এত বেশি উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন যে, তারই পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা যেভাবে সমান্তরাল গতিতে প্রবাহিত হয়ে সাধারণ জনগণ, এমনকি যে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা রচিত হয়েছিল সেই বাহিনীর সাধারণ সিপাহিদের মনমানসিকতাকেও প্রভাবিত করেছিল গভীরভাবে সে সম্পকের্ সচেতন ছিলেন না। স্বাধীন ভারত বা পাকিস্তানের জন্ম যে প্রতিক্রিয়ায় হয়েছিল, সুতীক্ষè বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা-পযাের্লাচনা-সমালোচনার তীর ঘেঁষে, বাংলাদেশের জন্ম কিন্তু তেমনভাবে হয়নি। বাংলাদেশ প্রাণ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। তাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ‘আমার দেশ’, ‘আমাদের জাতি’, ‘আমাদের রাষ্ট্র’, ‘আমাদের বাংলাদেশ’ প্রমুখ শব্দরাজি উচ্চারিত হয়েছে নতুন ব্যঞ্জনায়, নতুন বোধিতে, নতুন দ্যোতনায়। যেহেতু এক গণযুদ্ধের ফসল হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের আগেই এই ভ‚খÐে জাতীয়তার সূত্র সুদৃঢ় হয়েছে এবং চ‚ড়ান্ত পযাের্য় জাতি রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, তাই আন্তজাির্তক সমাজতান্ত্রিক পুনগর্ঠনের চেতনা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জাতীয়তাবাদী গণচেতনাও বিকশিত হয়েছে তেমনি প্রবল পরাক্রমে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে ভারতবিরোধী চিন্তাভাবনা এই চেতনাকে আরও শক্তিশালী করে। রক্ষীবাহিনী সংগঠন, এই বাহিনী সংগঠনে ভারতের প্রত্যক্ষ মদদ, এই বাহিনীর প্রতি সরকারের দুবর্লতা, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর উন্নয়নে সরকারের অনীহা, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিজয়োল্লাস, পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পাচারÑ এসবই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে ভারতবিরোধী মনোভাবকে ভীষণভাবে সঞ্জীবিত করে। সিপাহি-জনতার এই ভারতবিরোধী চেতনা চ‚ড়ান্ত পযাের্য় জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জয়যুক্ত করে। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারী খালেদ মোশাররফ এই চেতনার মোকাবেলায় সম্পূণর্রূপে ব্যথর্ হন। প্রথম আঘাতেই, বিশেষ করে যখন সিপাহি-জনতার মুখে ভারতবিরোধী ¯েøাগানগুলো উচ্চারিত হতে থাকে, সেই অভ্যুত্থান ঘায়েল হয়ে পড়ে। আজ জিয়াউর রহমান, তাহের এবং খালেদ মোশাররফ ইতিহাস। প্রশংসা বা সমালোচনার ঊধ্বের্ তারা। তাই এই দিনে তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন প্রয়োজন, কেননা যে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় বলে চিহ্নিত করি সেই মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিপুরুষ তারাই। এমাজউদ্দীন আহমদ: প্রাবন্ধিক, গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচাযর্, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়