রাজনৈতিক সংলাপ ও নিবার্চন

এই সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেশ ও জনগণের জন্য অমঙ্গল হবে এটা বলা বা ভাবা অযৌক্তিক এই কারণে যে, ক্ষমতার পালাবদল হলে একদিকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ হবে, অন্যদিকে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা বাংলাদেশকে ভূ-স্বগর্ বানাতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পায়ে পায়ে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমরা রাজনৈতিক বিভেদ দ্ব›দ্ব সংঘাতের মধ্যেই আছি। এটা আমাদের জন্য দুভার্গ্যজনক।

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘রাজনৈতিক সংলাপ’ একটি আলোচিত বিষয়। জাতীয় নিবার্চনকে সামনে রেখে এবারও কয়েক দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হলো। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে ফ্রন্টের নেতারা নিবার্চন পিছিয়ে সরকারের মেয়াদপূতির্র পরের ৯০ দিনে তত্ত¡াবধায়ক ব্যবস্থার আদলে ভোট করার দাবি তুলেছেন। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে এমন দাবি মেনে নেয়ার অবকাশ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপেও কোনো ‘সমাধান’ পাননি বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। এরমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, সংলাপ সফল হয়নি। তারা আন্দোলনে যাবেন। তাদের আলোচনা মনঃপূত হয়নি। সংলাপে কোনো সমাধান আসেনি। তারা আবারো বসতে চান, যেতে চান আলোচনা চালিয়ে। কিন্তু সে সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ ইতোমধ্যে তফসিল ঘোষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছেনÑ ‘সংবিধান পরিপন্থি ও সাংঘষির্ক কিছু বক্তব্য তারা নিয়ে এসেছে, যেটা গ্রহণযোগ্য না। সংলাপ এখানে শেষ। শিডিউল ঘোষণার পর তারা যদি কোনো ব্যাপারে আবার বসতে চান, আপত্তি নেই।’ আসলে দুই পক্ষই নিজেদের দাবিতে অনড়। তাদের পক্ষে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না। ক্ষমতাসীনরা মনে করেন সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন অনুষ্ঠানের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এর সরল অথর্ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সংবিধানের অধীনে নিবার্চন করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কথামতো নিবার্চন কেন করবে? যদি তত্ত¡াবধায়ক ব্যবস্থার আদলে নিবার্চন হয় তা হলে তারা সংবিধান সংশোধন করেছে কী কারণে। কোনো রকম আন্তজাির্তক চাপ কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে আওয়ামী লীগ নতি স্বীকার করবে বলে মনে হয় না। কারণ ওয়ান ইলেভেনের কথা তারা ভুলে যায়নি। এই সংলাপ যে একটি রাজনৈতিক কৌশল বা কূটনীতি এটা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বুঝতে পারেননি। তারা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক দূরশির্তার কাছে মার খেয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতে সংলাপ কতটুকু সফল হয়েছে তা কি তারা জানেন না। অতীতে যদি সংলাপ ব্যথর্ হয়ে থাকে, তা হলে এবার সফল হবে কীভাবে? তবে এবারের সংলাপের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি ছিল। এই সংলাপের মাধ্যমে সেই দূরত্ব অনেকটা কমেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনিবার্চনে কারচুপি হয়। এরপর তত্ত¡াবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে হরতাল অবরোধ শুরু করে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান সমঝোতার জন্য ঢাকায় আসেন। তার মধ্যস্থতায় সংলাপ ফলপ্রসূ হয়নি। এরপর ১৯৯৫ সালে সংকট নিরসনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন বিচারপতি কামাল উদ্দীন হোসেন, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, রেহমান সোবহান, ফখরুদ্দীন আহমদ ও সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদ। সেই মধ্যস্থতাও সফল হয়নি। ২০০১ সালে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চন দাবি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কাটার্র মধ্যস্থতার চেষ্টা করেও সফল হননি। ২০০৬ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ ও সিইসি এম এ আজিজের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলের আন্দোলন। বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভ‚ইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের মধ্যের বৈঠকও সফল হয়নি। ২০১৩ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকার প্রশ্নে জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফানাের্ন্দজ তারানকোর মধ্যস্থতায় সংলাপ হয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এবং বিএনপির মহাসচিব মিজার্ ফখরুলের বৈঠকও ব্যথর্ হয়। এবার ৭ দফা দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই দফা সংলাপ হয়েছে। সংলাপ হয়েছে এরশাদের জাতীয় পাটির্, বি চৌধুরীর বিকল্প ধারা ও অন্যান্য দলের সঙ্গেও। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি ক্ষমতাসীনদের পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি বলেই তারা সংলাপকে ব্যথর্ বলেছেন এবং আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এর আগে সরকারবিরোধী ও নিবার্চন বাতিল এবং প্রতিরোধের আন্দোলন করে কিন্তু মহাজোট সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি। তারা সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে ঠিকই সরকার গঠন করেছে। ক্ষতি হয়েছে দেশ ও জনগণের। এক বছরে পঁাচ শতাধিক মানুষ মারা গেছে। জাতীয় সম্পদের অশেষ ক্ষতি হয়েছে এবং হাজার হাজার বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করা হয়েছে। এর ফলে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আর বিনিময়ে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতায় যাওয়ার মূল শক্তি ও সুযোগ হচ্ছে জাতীয় নিবার্চন। এই নিবার্চনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসতে হবে, আন্দোলন করে অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে নয়। এখানে বলা সঙ্গত, শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় গুণ তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। যে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার তাকে নানাভাবে নিযার্তন ও হয়রানি করেছেন, তাকেই তিনি দিয়েছেন উপদেষ্টার মযার্দা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যেভাবে তাকে একের পর এক হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, তারপরেও তাদের সঙ্গে সংলাপে বসেছেন। শেখ হাসিনা আজ শুধু আওয়ামী লীগেরই নেতা নন, তিনি আজ দল-মতের ঊধ্বের্ উঠে স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। ইতিহাস যদি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নাম বুকে ধারণ করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার নামটি স্বণার্ক্ষরেই লেখা হয়ে থাকবে। তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কতর্ব্যসম্পন্ন হতে চলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কাযর্কর করার মধ্য দিয়ে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কাযর্কর হয়েছে। আজ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কমর্যজ্ঞ বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল নতুন অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভ‚তপূবর্। আর এই উন্নয়নের অন্যতম কারিগর মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে তিনি অনেক কিছু দিয়েছেনÑ সীমাহীন প্রতিক‚লতার মুখে পদ্মা সেতু নিমার্ণ কাজ শুরু যোগাযোগব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নয়ন ও অথৈর্নতিক অগ্রগতি তারই সুযোগ্য নেতৃত্বের ফসল। উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালনার কৃতিত্ব শেখ হাসিনারই। এই সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেশ ও জনগণের জন্য অমঙ্গল হবে এটা বলা বা ভাবা অযৌক্তিক এই কারণে যে, ক্ষমতার পালাবদল হলে একদিকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ হবে, অন্যদিকে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা বাংলাদেশকে ভূ-স্বগর্ বানাতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পায়ে পায়ে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমরা রাজনৈতিক বিভেদ দ্ব›দ্ব সংঘাতের মধ্যেই আছি। এটা আমাদের জন্য দুভার্গ্যজনক। স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো কতটুকু প্রতিফলিত করতে পেরেছি, তা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা উচিত। আমরা আসলে কী চেয়েছিলাম আর কী পেয়েছি? আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। আমরা চেয়েছিলাম অথৈর্নতিক মুক্তি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা কি তা পুরোপুরি পেয়েছি? বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বিবিএসের জরিপে বতর্মানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। কারণ দেশে যেভাবে শিল্পায়ন হওয়ার কথা ছিল ঠিক সেভাবে হয়নি। ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বন্ধ করা যায়নি। দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন তীব্র অথর্সংকট চলছে। আমাদের স্বপ্ন ছিল, এ দেশের মানুষ যাতে না খেয়ে কষ্ট না পায়, আমাদের দেশের মানুষ যাতে অশিক্ষিত না থাকে, তার ব্যবস্থা করা। আমরা তার কতটা পেরেছি? দেশ বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত হলেই স্বাধীন হয় না। পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন সাবের্ভৗম দেশ হিসেবে নাম খোদাই করা হলেই তার শান্তি-সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয় না। রাষ্ট্রকে হতে হয় গণতান্ত্রিক। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশ ও জনগণের ভাগ্যের যেমন পরিবতর্ন হয় না, স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদও তারা গ্রহণ করতে পারে না। সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হলে এই অপূণর্ কাজগুলো পূণর্ হবে। আশার কথা, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। ১৯৭১ সালের পর এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের কাছাকাছি। এখন তা ১৬০০ ডলার ছাড়িয়েছে। কেবল মাথাপিছু আয় বেড়েছে তা নয়, অথৈর্নতিক ও সামাজিক সূচকে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ অজর্ন করেছে বিস্ময়কর সাফল্য। তারপরেও আমাদের অজর্ন আর বিসজর্নকে পাশাপাশি দঁাড় করিয়ে আত্মমূল্যায়ন করতে হবে। বিবেককে জাগ্রত করে আত্মশুদ্ধির দিকেও যেতে হবে। এটা ব্যক্তির জন্য যতটা না বেশি প্রযোজ্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য। রাজনৈতিক অনৈক্য ও সংঘাতের কারণে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে আমরা তো অনেক বিসজর্ন দিলাম আর কত? এবার অংশগ্রহণ মূলক সুষ্ঠু নিবার্চনের মাধ্যমে অজর্নই হোক আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক