পাঠক মত

স্মৃতির মানসপটে যুক্তরাজ্য সফর

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বিদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই হয়ে থাকে। তবে কলেজের প্রতিনিধি, তথা দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এত অল্প বয়সে বিদেশ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়তো সবার হয় না। যেমনটা হয়েছে ক্যাডেট কলেজসমূহের সম্মিলিত যুক্তরাজ্যগামী দলের। ১২ ক্যাডেট কলেজ থেকে নিবাির্চত ১২ জন ক্যাডেটের একজন হতে পেরে আমি নিজেকে সত্যিই সৌভাগ্যবান মনে করি। যুক্তরাজ্যের মতো নয়নাভিরাম, ঐতিহ্যবাহী, প্রাচীন সভ্যতার ধারক এবং উন্নত একটি দেশ সফর করার অভিজ্ঞতার পুরোটাই ছিল রোমাঞ্চ ও আনন্দের ছেঁায়ায় ভয়পুর। ১৫ জনের সংযুক্ত দলে এ কে এম আজিজুল হক স্যার, আইরিন পারভীন ম্যাডাম এবং দলনেতা অ্যাডজুটেন্ট মেজর হিমেল মিঞা স্যারকে সঙ্গে পেয়ে আমাদের ১০ দিনের সফরটি হয়েছে আরও আনন্দঘন। যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে আমরা রওয়ানা হলাম ২০ জুন, ২০১৮। কাতার এয়ারওয়েজে আঠারো ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ শেষে আমরা লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পেঁৗছালাম সেখানকার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় এবং সেখানে আমাদের অভ্যথর্না জানালেন স্টো স্কুলের কম্বাইন্ড ক্যাডেট ফোসর্ (সিসিএফ) শাখার শিক্ষক ‘মেজর জেন’ এবং স্টাফ ‘সাজের্ন্ট ¯প্রæলস’। ‘স্টো’ স্কুলে পেঁৗছে মিনিভ্যান থেকে নামার পর যেমনটা মুগ্ধ হলাম স্কুলের অসাধারণ ক্যাম্পাস দেখে, তেমনটাই শিহরিত হলাম সেখানকার গ্রীষ্মকালীন বৈকালিক আবহাওয়ায়। পরিচিত হলাম সমবয়সী কয়েকজন ‘স্টোইকদের’ (স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পরিচিতিমূলক নাম) সঙ্গে যারা আমাদের নিয়ে গেল আমাদের জন্য নিধাির্রত কক্ষে। সেখানে সঙ্গের জিনিসপত্র রেখে আমরা ডাইনিং রুমে গেলাম। যেখানে আমাদের জন্য সান্ধ্যকালীন নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সূযর্ ডুবতেই আমরা ফিরে এলাম আমাদের কক্ষে। এসে পরিচ্ছন্ন হয়ে, জিনিসপত্র গুছিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে বিদায় জানালাম সেই দিনটিকে। পরদিন সকাল থেকে শুরু হয় পরিচিতি পবর্। ৭০০ একর জুড়ে বিস্তৃত ‘স্টো’ স্কুলের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সম্বন্ধে জেনে বেশ প্রীত হলাম। বিশেষ করে স্কুলের সৌকযর্মÐিত ভাস্কযর্সমূহ এবং সুরম্য অট্টালিকার ঐতিহ্যবাহী কাঠামো দেখে। বিকেল বেলা নেমে পড়লাম তাদের অপূবর্ সুন্দর কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কাটল বিকেলটি। ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা, হেড মাস্টারের সঙ্গে কথোপকথন, সান্ধ্যকালীন বারবিকিউ পাটির্ এবং কিছু স্যুভেনিয়র আদান-প্রদানের মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হলো দিনটি। ২২ তারিখ সকালে নাস্তা করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম লন্ডনের উদ্দেশে। ঘুরে দেখলাম ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি এবং আশ্চযর্ হলাম তাদের পরিচ্ছন্নতাবোধ দেখে। বাকিংহাম প্যালেসের গাডর্ মাউন্ট প্যারেড, হাউস অব লডর্স, লন্ডন আই, ওয়েলিংটন ব্যারেকস, ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেসহ ঘুরে দেখলাম লন্ডন শহরের নানা আকষর্ণীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। ছোট একটি ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ ঘটে গেল অভাবিতভাবে। এই দিনটি ছিল বাকিংহাম প্যালেসের গাডর্ পরিবতের্নর দিনÑ যা প্রতি দেড়মাস পরপর অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই পরিবতের্নর ইতিহাসেও প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ১৪০ পদক্ষেপে প্যারেডের পরিবতের্ ১৮০ পদক্ষেপে প্যারেড হলো প্রায় দৌড়ের মতো করে। সারাদিনের ঘোরাফেরা শেষে যখন ফিরে এলাম স্কুলের ক্যাম্পাসে, তখন সান্ধ্য অবসরে পরিচিত হলাম স্কুলে অধ্যয়নরত বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের মধ্যদিয়ে কেটে গেল সন্ধ্যা এবং নতুন বন্ধুত্বের সম্পকর্ গড়ে উঠল আমাদের মধ্যে। ২৩ তারিখ সকালে রীতিমতো নাস্তা সেরেই আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার যাত্রা করলাম অক্সফোডর্ শহরের উদ্দেশে। সফরের সময় জুড়েই আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন মেজর জেন এবং সাজের্ন্ট ¯প্রæলস। তাদের রসিকতা এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণে আমাদের পুরো সফরটাই কেটেছে আনন্দ-উল্লাসে। স্থানীয় বাসে ভ্রমণ করে যখন আমরা শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখতে মগ্ন, তখনই হঠাৎ জানতে পারি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রাক্তন-ক্যাডেটদের একটি দল আমাদের জন্য একটি প্রসিদ্ধ রেস্তোরঁায় ব্যুফে লাঞ্চের আয়োজন করেছে। এ কথা জানার পর আমাদের উল্লাস আর দেখে কে! রেস্তোরঁায় পেঁৗছতেই আমাদের সানন্দে অভ্যথর্না জানালেন প্রাক্তন-ক্যাডেটরা। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-আড্ডা শেষে প্রাক্তন-ক্যাডেটদের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু স্যুভিনিয়র দেয়া হলো। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম, রওয়ানা হলাম কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। অক্সফোডের্র নামিদামি দোকান থেকে কিনলাম পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য কিছু উপহার এবং নিজের জন্যও কিছু জিনিস। সন্ধ্যায় স্কুলে পেঁৗছতেই জানলাম সেদিন স্টোইকদের চলছে সাপ্তাহিক বিনোদন সন্ধ্যা; যাকে তারা বলে ‘স্টোবাক্স’। হাতমুখ ধুয়ে আমরা কেউ কেউ যোগ দিলাম ‘স্টোবাক্সে’ কেউ কেউ সময় কাটালাম হাউসের কমন রুমে। বিনোদনের মধ্যদিয়ে শেষ হয়ে এলো সেই দিনটি। ২৪ তারিখ ছিল স্কুলে ক্যাম্পাসে আমাদের শেষ দিন। সে দিন আমাদের প্রথম খাবারের আয়োজন ছিল ‘ব্রাঞ্চ’ যা কিনা ছিল ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চের মাঝামাঝি সময়ে। জিনিসপত্র গুছিয়ে যখন আমরা সি.সি.এফ আমির্ সেকশন সামার ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতÑ যা ছিল আমাদের সফরের মূল ইভেন্ট; তখন বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের ডিফেন্স অ্যাটাশে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং কিছু বাতার্ আদান-প্রদান করেন। দু’ঘণ্টার যাত্রা শেষে ক্যাম্পে পেঁৗছাতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পের আবাসনে। আবাসনে সুস্থির হতে না হতেই আমাদের বাংলাদেশ ক্যাডেট দলকে নিয়ে যাওয়া হয় রাইফেল প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়ে আমাদের দিনটি সমাপ্ত হয়। ২৫ তারিখ, ট্রেনিংয়ের প্রথমদিন ছিল সবচেয়ে ঘটনাবহুল। কেননা, সে দিনকার কাযর্ক্রমই ছিল পুরোটা রোমাঞ্চকর অভিযান। টাওয়ার ক্লাইম্বিং, মাউন্টেন বাইকিং, অ্যারো ট্যাগ, রং বো এবং ওয়াটার অ্যাকটিভিটিস ছিল সেদিনকার আকষর্ণীয় দিক। বিশাল লেকের মধ্যে কায়াকিং, র‌্যাফটিং ইত্যাদি ছিল সবচেয়ে আনন্দদায়ক। দিনব্যাপী এই কমর্কাÐ খুবই সুবিন্যস্ত ছিল। সমতল, পাহাড়, অরণ্য আর পানির মধ্যে বিন্যস্ত এসব কমর্কাÐে দিনটি কোনদিক দিয়ে শেষ হয়েছে তাও বুঝতে পারিনি। রোমাঞ্চ আরো বেড়ে যায়, যখন আইরিন ম্যাডাম, আজিজ স্যার এবং হিমেল স্যারও আমাদের সঙ্গে নানা কাযর্ক্রমে অংশগ্রহণ করেন। ২৬ এবং ২৭ তারিখে ছিল নানান শুটিং কাযর্ক্রম, তীর নিক্ষেপ, শটগান, প্রতিবন্ধক দৌড়, পেইন্টবল শুটিং, লেসার কোয়েস্ট, প্রাথমিক চিকিৎসা, রুম ক্লিয়ারেন্স, ট্র্যাকিংসহ আরো নানারকম সামরিক প্রশিক্ষণ। কাযর্ক্রমগুলোতে বাংলাদেশের ক্যাডেটদের অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ এবং প্রশংসনীয়। প্রশিক্ষকরা বিস্মিত হয়েছেন আমাদের দ্রæত শেখার এবং আয়ত্তে আনার ক্ষমতা দেখে। ট্রেনিং চলাকালীন সবর্দাই আমাদের কঁাধে ছিল ভারী ব্যাগ এবং রাইফেল। তবে রোমাঞ্চের উচ্ছ¡াসে সব কষ্টই যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। প্রশিক্ষণের সব কাযর্ক্রমই ঘন বন-জঙ্গলে হয়েছিল এবং সেদিন আমরা রাত্রিও যাপন করেছিলাম গহীন বনের গভীর অঁাধারে। জঙ্গলে আমাদের সারাদিনের খাবারের উৎস ছিল রেশনের একটি বাক্স যাতে ছিল রান্না করার নানা সামগ্রী এবং অধর্-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আর ছোট একটি ফিল্ড স্টোভ। ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে সেই স্টোভ জ্বালিয়ে কোনমতে প্যাকেটগুলো গরম করে খাওয়ার মধ্যেও ছিল অসীম তৃপ্তি। পরদিন সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত সব কাযর্ক্রমের মধ্যে ছিল অ্যাম্বুশ, পেট্রোল এন্ড রেইড এবং নানা বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ অত্যন্ত আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে সেদিন শেষ হলো সি.সি.এফের রোমাঞ্চপূণর্ প্রশিক্ষণ কাযর্ক্রম। এতদিন ব্রিটিশদের সঙ্গে থাকা, কাযর্ক্রমে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করা, অপরাপর দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আবহাওয়া, জীবিকা সম্পকের্ কথোপকথন ইত্যাদি গড়ে তুলেছিল আমাদের এবং ব্রিটিশদের মধ্যে এক বন্ধুত্বের সম্পকর্। ক্যাম্প শেষে লন্ডনের উদ্দেশে ফেরার আগে তাদের বিদায় জানাতে গিয়ে সেটা বুঝলাম। যুক্তরাজ্যের মনোরম আবহাওয়া, স্টো স্কুলের ক্যাম্পাস এবং সেখানকার বন্ধুদের ছেড়ে চলে আসতে হবে ভেবেই আমাদের খারাপ লাগছিল, তবে সত্যিই বুঝলাম যে, এত সুন্দর অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে পেরে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। যুক্তরাজ্য সফরের প্রতিটি মুহূতর্ তুলে রেখেছি ক্যামেরার মেমোরিতে। হয়তো সেটি হারিয়ে যেতে পারে, তবে হৃদয়ের গভীরে আজীবন স্মরণ থাকবে এই সফরের কথা, সফরকারী দলের প্রতিটি হাসিমুখের কথা; বিশেষ করে আজিজ স্যারের রসিকতা, আইরিন ম্যাডামের স্নেহভরা যতœ এবং অবশ্যই হিমেল স্যারের দেয়া প্রত্যেকটি আপ্যায়নের কথা। ক্যাডেটদের প্রত্যেকে ভিন্ন জেলার ভিন্ন কলেজের হলেও সবর্দা আমাদের মধ্যে ছিল এক অতুলনীয় ভ্রাতৃত্বের ও ঐক্যের বন্ধন। খুব অল্প সময়েই আমরা বন্ধুত্বের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হয়েছি এবং দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি একটি দল হিসেবে। এই সফরের প্রতিটি মুহূতর্ এবং অভিজ্ঞতা মনে থাকবে আজীবন। হয়তো জীবনে চলার পথে ভ্রমণ হবে নানা দেশে, হবে নতুন অভিজ্ঞতা; তবে এই সফরের সমতুল্য কোনোটিই হবে না। স্মৃতির মানসপটে এই সফরটি হয়ে থাকবে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং অ¤øান। ক্যাডেট ইফতেখার ক্যাডেট নং-৩০৭৭ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ যানজটের পাশাপাশি শব্দদূষণের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা সম্ভবত বিশ্বের নগরকুলের মধ্যে শিরোপার